দু'শ্রেণির লোক জাহান্নামী | Du'Srenir Lok Jahannami

ড. আবু তাবাসসুম

عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : صِنْفَانِ مِنْ أَهْلِ النَّارِ لَمْ أَرَهُمَا، قَوْمٌ مَعَهُمْ سِيَاطٌ كَأَذْنَابِ الْبَقَرِ يَضْرِبُونَ بِهَا النَّاسَ، وَنِسَاءٌ كَاسِيَاتٌ عَارِيَاتٌ مُمِيلاتٌ مَائِلَاتٌ رُءُوسُهُنَّ كَأَسْمَةِ الْبُخْتِ الْمَائِلَةِ، لا يَدْخُلْنَ الجنَّةَ، وَلا يجدن ريحها، وإن ريحها لَيُوجَدُ مِنْ مَسِيرَةِ كَذَا وَكَذَا

অনুবাদ : “আবু হুরাইরা (রা.) বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, দু'শ্রেণির লোক জাহান্নামী হবে, যাদেরকে আমি দেখিনি : ঐ সম্প্রদায়, যাদের সাথে গরুর লেজের মত চাবুক থাকবে, যা দ্বারা লোকদেরকে প্রহার করবে। ঐ সকল নারী যারা কাপড় পরেও উলঙ্গ, অন্যকে বিপথগামী করে এবং নিজেরাও বিপথগামী, আর মাথা উটের দুল খাওয়া কুঁজের মত। এরা কখনোই জান্নাতে প্রবেশ করবে না এবং তার ঘ্রাণও পাবে না, যদিও তার ঘ্রাণ বহু দূর থেকে পাওয়া যাবে। [মুসলিম, কিতাবুল লিবাস-২১২৮]

ব্যাখ্যা : এ হাদীছে দু'শ্রেণির লোকের বর্ণনা দেওয়া হয়েছে, যারা জাহান্নামী হবে। তবে এ দু'শ্রেণির লোক রাসূলুল্লাহ (সা.) শাসনকালে ছিল না। পরবর্তিতে তাদের উদ্ভব ঘটবে বলে হাদীছে ভবিষ্যৎ বাণী করা হয়েছে এবং পরবর্তিতে তাদের উদ্ভব হয়েছে। এটি রাসূলুল্লাহ (সা.) এর একটি মু'জিযা। প্রথম শ্রেণি হলো জালিম শাসক-প্রশাসক, প্রতিপত্তিশালী শ্রেণি, যারা সর্বদা লোকদেরকে নিপীড়ন করে, যাদের অত্যাচারে লোকেরা অতিষ্ট অথবা তটস্থ। এ শ্রেণির লোকেরা জাহান্নামে যাবে। কারণ মানুষকে নিপীড়ন করা বা কষ্ট দেওয়া ঈমান ও ইসলামের পরিপন্থী কাজ। 

রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন,

اللهُ عَنْهُ «المُسْلِمُ مَنْ سَلِمَ المُسْلِمُونَ مِنْ لِسَانِهِ وَيَدِهِ، وَالْمُهَاجِرُ مَنْ هَجَرَ مَا نَهَى ا 

মুসলিম সে ব্যক্তি, যার কথা ও হাত (কাজ) থেকে মুসলিমগণ নিরাপদ থাকে। আর মুহাজির সে ব্যক্তি যে ব্যক্তি আল্লাহর নিষিদ্ধ করা কাজকে বর্জন করে। [বুখারী, কিতাবুল ঈমান- ১০]

অন্য হাদীছে রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন,

إِنَّ اللهَ عَزَّ وَجَلَّ يُعَذِبُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ الَّذِينَ يُعَذِّبُونَ النَّاسَ فِي الدُّنْيَا 

নিশ্চয় মহাপরাক্রমশালী, মর্যাদাবান আল্লাহ কিয়ামতের দিন তাদেরকে শাস্তি দেবেন, যারা দুনিয়াতে মানুষকে শাস্তি দেয়। এমন কি যারা কথা বা আচরণের দ্বারও কাউকে কষ্ট দেয়, তারাও জাহান্নামী হবে বলে হাদীছে বর্ণিত হয়েছে। [শো'আবুল ঈমান- ৪৯৭০]

عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، رَضِيَ اللهُ عَنْهُ قَالَ: قِيلَ لِلنَّبِيّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: إِنَّ فُلَانَةَ تَومُ النَّهَارَ وَتَقُومُ اللَّيْلَ وَتُؤْذِي جِيرَانَهَا بِلِسَانِهَا فَقَالَ: «لا خَيْرَ فِيهَا هِيَ فِي النَّارِ» ، قِيلَ: فَإِنَّ فَلَانَةَ تُ لِي الْمَكْتُوبَةَ هي في بلسانها وَتَومُ رَمَضَانَ وَتَتَ صَدَّقُ بِأَنْوَارٍ مِنْ أَقِطٍ وَلَا تُؤْذِي أَحَدًا

আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নাবী (সা.)কে বলা হলো, অমুক মহিলা দিনে সাওম পালন করে এবং রাত জেগে ইবাদাত করে, কিন্তু সে তার কথার দ্বারা প্রতিবেশীদেরকে কষ্ট দেয়। তিনি বললেন, এতে তার কোনো কল্যাণ নেই, সে জাহান্নামী। বলা হলো, অমুক মহিলা ফরজ সালাত আদায় করে এবং রামাযানে সিয়াম পালন করে এবং পনিরের কিছু টুকরা দান করে, কিন্তু সে কথার দ্বারা কাউকে কষ্ট দেয় না। তিনি বললেন, সে জান্নাতী। [হাকিম, আল মুস্তাদ্রাক 'আলাস সাহীহাইন- ৭৩০৫]

সুতরাং শাসক, প্রশাসক, আইনশৃংখলা কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গ, রাজনৈতিক নেতা-কর্মী ও অন্যান্য সকলকে সতর্ক থাকতে হবে, যাতে তাদের দ্বারা অন্যায়ভাবে কোনো ব্যক্তি কষ্ট বা শস্তি না পায়। অন্যথায় আখিরাতে কঠিন শাস্তির সম্মুখীন হতে হবে।

অন্য আরেকটি শ্রেণি যারা জাহান্নামে যাবে তারা হলো নারী :

Du'Srenir Lok Jahannami

এরা সে সকল নারা, যারা অসৎ কর্মপরায়ণ ও ফাসিক-ফাজির। এরা আল্লাহর বিধানের কোনো তোয়াক্কা করেনা। এরা নিজের নফসের ও শয়তানের তাবেদার। ফলে তাদের কাজ-কর্ম, চলাফেরা ইত্যাদি হয়ে থাকে শালীনতা ও আল্লাহর বিধি-বিধান বিবর্জিত। এরা পর্দার বিধান বা ইসলামের বিধানের কোনো ধার ধারে না। নিজের দেহ ও পোষাক পরিচ্ছদ আকর্ষণীয় করে অন্য পুরুষের সামনে প্রকাশ করাকে এরা ফ্যাশন হিসেবে গ্রহণ করে। এরা দেহের বিভিন্ন অংশ খোলা রেখে বাইরে চলাফেরো করে । হাদীছটিতে এদের যে বর্ণনা দেওয়া হয়েছে, তাহলো, কাপড় পরেও উলঙ্গ। অর্থাৎ এরা শরীরের কিছু অংশ আবৃত করে এবং কিছু অংশ খোলা রাখে। অথবা এমন পাতলা কাপড় পরিধান করে যার ভিতর দিয়ে শরীর দেখা যায়। আবার কেউ কেউ বলেছেন, এরা আল্লাহর নিয়ামত ভোগ করে কিন্তু তার শুকরিয়া আদায় করে না । এরা লোকদেরকে বিপথগামী করে। অর্থাৎ এরা এদের মন্দ কাজ অন্যকেও অবহিত করে এবং অন্যদেরকে সে দিকে আকৃষ্ট ও আহবান করে বিপথগামী করে।

এরা নিজেরাও বিপথগামী। অর্থাৎ এরা আল্লাহর আনুগত্য ও তাদের জন্য যা মেনে চলা আবশ্যক, তা থেকে বিচ্যুত হয়ে ভ্রান্ত পথে নিজেকে পরিচালিত করে। অথবা এরা নষ্টা মেয়েদের মত বিকৃত ভঙ্গিতে হেলে দুলে চলে।

উটের দুল খাওয়া কুঁজের মত এদের মাথা। অর্থাৎ এরা কাপড় বা অন্য কিছু দিয়ে মাথার

খোপাকে উঁচু ও বড় করে প্রদর্শন করে। এ ধরনের বেপর্দা ও বেহায়া নারীরা জান্নাতে যেতে পারবে না। জান্নাতে যাওয়া দূরে থাক, এরা জান্নাতের ঘ্রাণও পাবেনা।

নারী পুরুষ মিলেই মানবজাতি :

এ দু'য়ের পরস্পর মিলনেই মানবধারা বহমান। একটি নারী এবং একটি পুরুষের মিলনের ফলেই পরিবার গঠিত হয়। পরিবার থেকেই সমাজের সৃষ্টি। এ উভয়ের পারস্পরিক সহযোগিতায় সমাজ ক্রিয়াশীল। সমাজের শৃংখলা, স্থিতি ও স্থায়িত্ব এবং শান্তি ও স্বস্থির জন্যই নারী-পুরুষের মিলনকে বিধিবদ্ধ নিয়মের নিগড়ে বেধে দেওয়া হয়েছে। বিধিবদ্ধ নিয়মের বাইরে নারী-পুরুষের অবাধ মেলমেশা বিশৃংখলার জন্ম দেয় এবং ফলশ্রুতিতে সমাজের স্থিতি ও শান্তি বিনষ্ট হয়। এজন্য ইসলাম নারী-পুরুষের অবৈধ ও অবাধ মেলামেশাকে নিষিদ্ধ করেছে। এ অবাধ মেলামেশা রোধকল্পেই পর্দা প্রথার প্রবর্তন করা হয়েছে, যাতে বিধিবহির্ভূতভাবে মিলিত হয়ে বিশৃংখলার জন্ম দিতে না পারে।

এটিকে বিদ্যুৎ ব্যবস্থাপনার সাথে তুলনা করা যেতে পারে।


Electricity

আমরা জানি যে, বিদ্যুতের দু'টি ধারা থাকে। একটি পজেটিভ এবং অন্যটি নেগেটিভ। এ দু'টি ধারাকে বিশেষ নিয়মে সংযোজিত করলে তা থেকে আমরা আলো ও শক্তি পাই। কিন্তু বিশেষ নিয়মের বাইরে এ দু'টি মিলিত হলে দুর্ঘটনা ঘটে এবং কল্যাণের পরিবর্তে অকল্যাণ সাধিত হয়। এজন্য এ দু'টি ধারাকে সাধারণভাবে পৃথক রাখার লক্ষ্যে তাদের গায়ে আবরণ দিয়ে দেওয়া হয়। ফলে এ দু'টি যত্র-তত্র মিলিত হয়ে বিপর্যয় সৃষ্টি করতে পারে না, কিন্তু বিশেষ নিয়মে মিলিত করে তা থেকে প্রভূত কল্যাণ লাভ করা সম্ভব হচ্ছে। 

অনুরূপভাবে মানব জাতির ধারাবাহিকতা রক্ষা এবং এর স্থিতি ও কল্যাণের জন্য নারী ও পুরুষ এ দু'টি ধারা তৈরী করা হয়েছে। এ দু'টি ধারাকে একত্রিত করে বংশধারা অব্যাহত রাখা, শান্তি ও স্থিতি বজায় রাখা এবং এর মাধ্যমে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র গঠন এবং সভ্যতার উদ্ভব ও বিস্তার ঘটানো অব্যাহত রাখা হয়েছে। ইসলাম বিবাহের মাধ্যমে এ দু'টি ধারাকে এক জায়গায় মিলিত বা একত্রিত করেছে। অর্থাৎ বিবাহ বন্ধনের মাধ্যমে নারী পুরুষকে মিলিত করে যৌন সম্ভোগের ব্যবস্থা করেছে। এর বাইরে নারী পুরুষের মিলনের সুযোগ রাখা হয়নি, বরং নিষিদ্ধ করা হয়েছে। যদি এ সুযোগ রাখা হতো তাহলে তা একদিকে যেমন বিশৃংখলার জন্ম দিত, অন্য দিকে তেমনি মানব বংশ কলংকিত ও সংন্দেহ-সংশয়িত হত এবং স্থিতি, শান্তি ও সভ্যতা বিনষ্ট হত, কল্যাণ ও শান্তির পরিবর্তে অকল্যাণ ও অশান্তির ক্রমধারা প্রবাহিত হতে থাকতো। 

ইসলাম যে কাজকে নিষিদ্ধ করেছে, সে কাজের মাধ্যম বা সে কাজের দিকে পৌঁছার সকল পথ বন্ধ করে দিয়েছে, যাতে মানুষ সে দিকে ধাবিত হতে না পারে। কারণ কোন বস্তুকে হারাম ঘোষণা করে তার নিকট পৌছার মাধ্যম ও পন্থাসমূহকে বৈধ ও উন্মুক্ত করে দিলে তা হবে স্ববিরোধিতা, হারাম ঘোষণাকে পণ্ড করার শামিল এবং নাফস বা প্রবৃত্তিকে উক্ত হারাম কাজের প্রতি অনুপ্রেরণা দানকারী। আল্লাহ তা'আলার প্রজ্ঞা এটিকে কোন ক্রমেই স্বীকৃতি দিতে পারে না। 

এ প্রসঙ্গে ইবনুল কায়্যিম বলেন,

“মহান প্রভূ যখন কোন কিছু হারাম ঘোষণা করেন, যার দিকে পৌঁছার বিভিন্ন পথ ও · উপকরণ রয়েছে, তখন তিনি সে পথগুলোকেও হারাম করে দেন এবং তা থেকে বারণ করেন, যাতে সে হারামটি প্রকৃতঃপক্ষেই প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। আর এজন্য তিনি তার সীমানার কাছে যেতেও আমাদেরকে নিষেধ করেন।” [ইবনুল কায়্যিম, ই'লামুল মু'আক্কিঈন আন রাব্বিল আলামীন, খ. ৩, পৃ. ১৭৫।]

তিনি আরো বলেন,

“যদি হারামের দিকে ধাবিতকারী কারণ ও মাধ্যমসমূহ বৈধ রাখা হত, তাহলে তা হত হারামকে পণ্ডকারী এবং নফস বা প্রবৃত্তিকে সেদিকে অনুপ্রেরণা দানের শামিল। আর আল্লাহর হিকমাত ও জ্ঞান এটাকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করে।” [প্রাগুক্ত]

ইমাম খাত্ত্বাবী (রহ.) বলেন, 

“প্রতিটি বিষয়, যা নিষিদ্ধ কাজের মাধ্যম হয়, তাও নিষিদ্ধ ।” [ওয়ালিউদ্দীন মুহাম্মাদ, মিশকাতুল মাসাবীহ, কিতাবুয যাকাত, প্রথম ফসল, পৃ. ১৫৬।]

হারাম ও নিষিদ্ধ কাজ থেকে মানুষকে নিবৃত্ত করার জন্য সেদিকে যাওয়ার সকল পথ বন্ধ করে দেয়া জরুরী, যাতে লোকেরা সেদিকে যাওয়ার কোন বাহানার অবকাশ না পায় । মোট কথা বিজ্ঞ শারী আত প্রণেতা ক্ষতিকর বস্তু ও বিষয়সমুহ নিষিদ্ধ করেছেন এবং সাথে সাথে সে দিকে যাওয়ার সকল পথ ও মাধ্যমগুলোও বন্ধ করে দিয়েছেন। বিপর্যয়কর ও অনিষ্টকর বস্তুগুলোকে যেমন হারাম করা হয়েছে, তেমনিভাবে সেগুলোর দিকে পৌঁছার মাধ্যম ও উপায় উপকরণকেও হারাম করা হয়েছে। এটি শারী'আতের একটি গুরুত্বপূর্ণ মূলনীতি। 

জিনার দিকে উদ্বুদ্ধকারী মাধ্যম এবং পন্থাও নিষিদ্ধ 

শারী'আতের উপরোক্ত মূলনীতির আলোকে জিনা-ব্যভিচারকে নিষিদ্ধ করার সাথে সাথে এর প্রতি প্ররোচনাদানকারী ও উদ্বুদ্ধকারী সবকিছুকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে এবং জিনা-ব্যভিচারের দিকে পৌঁছার সকল চোরাপথ বন্ধ করে দিয়েছে। জিনাকে নিষিদ্ধকারী হুকুম -"আর তোমরা জিনার ধারে-কাছেও যেওনা, কারণ এটি অশ্লীল জঘন্যতম পথ” [১৭-সূরা বানী ইসরাঈল : ৩২] নাযিল করার সাথে সাথে জিনার দিকে আকৃষ্টকারী পথসমূহ বন্ধের প্রয়োজনীয় বিধি-নিষেধ আরোপ করেছেন। এ বিধি-নিষেধের সমষ্টিই হলো হিজাব বা পর্দা ব্যবস্থা। 

পর্দার বিধান :

হিজাব বা পর্দার বিধানকে ইসলাম ফরয করে দিয়েছে। আর এর মূল লক্ষ্য হলো যাতে নারী-পুরুষ অননুমোদিত পন্থায় পরষ্পরের সান্নিধ্যে আসতে না পারে। কারণ এটিই ক্রমান্বয়ে তাদেরকে যিনার দিকে ধাবিত করে। এ জন্য এ পথে পদে পদে বাধার সৃষ্টি করা হয়েছে, যাতে নিষিদ্ধ স্থানে পৌঁছাতে না পারে। নিম্নে এগুলোর বিবরণ দেওয়া হলো,

১. ইসলাম নারী ও পুরুষের অবস্থান এবং কর্মক্ষেত্র পৃথক করে দিয়েছে। একান্ত প্রয়োজন ছাড়া নারী-পুরুষের সাক্ষাৎ, অযথা কথাবার্তা ও আলাপচারিতা, ঠাট্টা-মশকরা ও রসিকতা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করেছে। আল্লাহ তাআলা বলেন, 

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لا يَسْخَرْ قَوْمٌ مِنْ قَوْمٍ عَسَى أَنْ يَكُونُوا خَيْرًا مِنْهُمْ وَلَا نِسَاءٌ مِنْ نِسَاءٍ عَسَى أَنْ يَكُنَّ خَيْرًا مِنْهُنَّ

হে ঈমানদারগণ, পুরুষরা যেন অন্য পুরুষদের বিদ্রুপ না করে। হতে পারে তারাই এদের চেয়ে উত্তম। অনুরূপভাবে নারীরাও যেন অন্য নারীদেরকে বিদ্রুপ না করে। হতে পারে তারাই এদের চেয়ে উত্তম।” [৪৯-সূরা আল হুজুরাত : ১১]

এ আয়াতের ব্যাখ্যায় ‘আল্লামা সায়্যিদ আবুল আ'লা মওদূদী (রহ.) বলেন, “পুরুষ ও নারীদের কথা আলাদা করে উল্লেখ করার অর্থ এ নয় যে, পুরুষদের নারীদেরকে বিদ্রুপের লক্ষ্য বানানো এবং নারীদের পুরুষদেরকে হাসি তামাশার লক্ষ্য বানানো জায়িয। মূলত যে কারণে নারী ও পুরুষদের বিষয় আলাদা করে উল্লেখ করা হয়েছে তা হচ্ছে, ইসলাম এমন সমাজ আদৌ সমর্থন করে না, যেখানে নারী-পুরুষ অবাধে মেলামেশা করতে পারে। অবাধ খোলামেলা মজলিসেই সাধারণত: একজন আরেকজনকে হাসি-তামাসার লক্ষ্য বানাতে পারে। মুহাররাম নয় এমন নারী-পুরুষ কোন মজলিসে একত্র হয়ে পরস্পর হাসি-তামাসা করবে, ইসলামে এমন অবকাশ আদৌ রাখা হয়নি। তাই একটি মুসলিম সমাজে একটি মজলিসে পুরুষ কোন নারীকে উপহাস ও বিদ্রুপ করবে কিংবা নারী কোন পুরুষকে বিদ্রুপ ও উপহাস করবে এমন বিষয় কল্পনার যোগ্য মনে করা হয়নি। [তাফহীমুল কুরআন, সূরা আল হুজুরাত, টীকা নং ২০, খ. ১৫।]

২. ইসলাম নারীদেরকে বাড়ীতে অবস্থান করতে বলেছে। কোনো প্রয়োজনে বাইরে যেতে হলে

সাজসজ্জা করে আকর্ষণীয়রূপে বের হতে নিষেধ করা হয়েছে। আল কুরআনে বলা হয়েছে,

وَقَرْنَ فِي بُيُوتِكُنَّ وَلَا تَبَرَّجْنَ تَبَرُّجَ الْجَاهِلِيَّةِ الأُولَى

“তোমরা তোমাদের গৃহেই অবস্থান কর এবং প্রথম জাহিলী যুগের নারীদের মত খোলামেলাভাবে বের হয়োনা।” [৩৩-সূরা আহযাব : ৩৩]

৩. কোনো প্রয়োজনে বের হতে হলে ভালভাবে শরীর ঢেকে বের হতে বলা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহর ঘোষণা হলো, 

يَا أَيُّهَا النَّبِيُّ قُلْ لِأَزْوَاجِكَ وَبَنَاتِكَ وَنِسَاءِ الْمُؤْمِنِينَ يُدْنِينَ عَلَيْهِنَّ مِنْ جَلَابِيبِهِنَّ ذَلِكَ أَدْنَ أَنْ يُعْرَفْنَbفَلَا يُؤْذَيْنَ وَكَانَ اللَّهُ غَفُورًا رَحِيمًا

“হে নবী, আপনি আপনার স্ত্রী, কন্যা এবং মুমিন নারীদেরকে বলে দিন তারা যেন নিজেদের উপর চাদর টেনে নেয়।” [৩৩-সূরা আহযাব : ৫৯]

৪. চলতে ফিরতে নারী-পুরুষের পরস্পরে সাক্ষাৎ ঘটলে স্ব-স্ব দৃষ্টি অবনত রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কুরআন কারীমে বলা হয়েছে,

قُلْ لِلْمُؤْمِنِينَ يَغُضُّوا مِنْ أَبْصَارِهِمْ وَيَحْفَظُوا فُرُوجَهُمْ ذَلِكَ أَزْكَى لَهُمْ إِنَّ اللَّهَ خَبِيرٌ بِمَا يَصْنَعُونَ وَقُلْ لِلْمُؤْمِنَاتِ يَغْضُضْنَ مِنْ أَبْصَارِهِنَّ وَيَحْفَظْنَ فُرُوجَهُنَّ وَلا يُبْدِينَ زِينَتَهُنَّ إِلَّا مَا ظَهَرَ مِنْهَا وَلْيَضْرِبْنَ بِخُمُرِهِنَّ عَلَى جُيُوبِهِنَّ وَلَا يُبْدِينَ زِينَتَهُنَّ إِلَّا لِبُعُولَتِهِنَّ أَوْ آبَائِهِنَّ أَوْ آبَاءِ بُعُولَتِهِنَّ أَوْ أَبْنَائِهِنَّ أَوْ أَبْنَاءِ بُعُولَتِهِنَّ أَوْ إِخْوَانِهِنَّ أَوْ بَنِي إِخْوَانِهِنَّ أَوْ بَنِي أَخَوَاتِهِنَّ أَوْ نِسَائِهِنَّ أَوْ مَا مَلَكَتْ أَيْمَانُهُنَّ أَوِ التَّابِعِينَ غَيْرِ أُولِي الْإِرْبَةِ مِنَ الرِّجَالِ أَوِ ال ِسّفْلِ الَّذِينَ لَمْ يَظْهَرُوا عَلَى عَوْرَاتِ النِّسَاءِ وَلَا يَضْرِبْنَ بِأَرْجُلِهِنَّ لِيُعْلَمَ مَا يُخْفِينَ مِنْ زِينَتِهِنَّ وَتُوبُوا إِلَى اللَّهِ جَمِيعًا أَيُّهَ الْمُؤْمِنُونَ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ 

“আপনি মুমিন পুরুষদেরকে বলে দিন তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে অবনত রাখে এবং লজ্জাস্থানকে হিফাজত করে। এটাই তাদের পরিশুদ্ধির জন্য সর্বোত্তম। নিশ্চয়ই তারা যা করে আল্লাহ সে সম্পর্কে খবরদার। আপনি মুমিন নারীদেরকেও বলে দিন, তারা যেন তাদের দৃষ্টি অবনত রাখে এবং লজ্জাস্থানকে হিফাজত করে। আর তারা যেন স্বাভাবিকভাবে যা প্রকাশিত থাকে, তা ব্যতীত তাদের সৌন্দর্য প্রকাশ না করে এবং বুকের উপর চাদর জড়িয়ে চলাফেরা করে। আর স্বামী, পিতা, স্বামীর পিতা, ছেলে, স্বামীর ছেলে, ভাই, ভ্রাতুষ্পুত্র, ভগিনীপুত্র, নিজস্ব বলয়ের নারী, অধিনস্ত ক্রীতদাস, তাদের অনুসারী যৌন অনুভূতিহীন পুরুষ এবং মহিলাদের গোপনীয় বিষয়ে অবহিত নয় এমন শিশু ব্যতীত অন্য কারো নিকট যেন তারা তাদের সৌন্দর্য প্রকাশ না করে। আর পথ চলতে তারা যেন এমনভাবে পা না ফেলে, যাতে তাদের গোপন সৌন্দর্য জানা যায়। মুমিনগণ, তোমরা সকলে আল্লাহর নিকট তাওবা কর, যাতে তোমরা সফলকাম হতে পার।” [২৪-সূরা আন্ নূর : ৩০-৩১]

৫. নারীদের নিকট পুরুষদের কোন কিছু চাওয়ার প্রয়োজন হলে পর্দার অন্তরাল থেকে চাওয়ার জন্য বলা হয়েছে। 

কুরআন কারীমে বলা হয়েছে, 

وَإِذَا سَأَلْتُمُوهُنَّ مَتَاعًا فَاسْأَلُوهُنَّ مِنْ وَرَاءِ حِجَابٍ ذَلِكُمْ أَطْهَرُ لِقُلُوبِكُمْ وَقُلُوهِنَّ 

“যখন তোমরা তাদের (নবী পত্নীগণের) নিকট কোনো কিছু চাও, তা চাও পর্দার আড়াল থেকে, এটাই তোমাদের এবং তাদের অন্তরের জন্য পবিত্রতম।” [ ৩৩-সূরা আহযাব : ৫৩]

৬. একান্ত প্রয়োজনে কোনো নারীকে কোনো পুরুষের সাথে কথা বলতে হলে, অত্যন্ত শালীনতা ও সতর্কতার সাথে কথা বলতে বলা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তা'আলা

ইরশাদ করেন, 

با نِسَاءَ النَّبِيِّ لَسْتُنَّ كَأَحَدٍ مِنَ النِّسَاءِ إِنِ اتَّقَيْتُنَّ فَلَا تَخْضَعْنَ بِالْقَوْلِ فَيَ مَعَ الَّذِي فِي قَلْبِهِ مَرَضٌ وَقُلْنَ قَوْلًا مَعْرُوفًا

“হে নবী পত্নীগণ, তোমরা অন্য কোনো নারীর মত নও। যদি তোমরা আল্লাহকে ভয় করে থাক, তাহলে কোমল কন্ঠে কথা বলো না, যাতে ব্যধিগ্রস্ত অন্তরের লোকেরা লোভাতুর হয়ে পরে, আর তোমরা কথা বলবে সঙ্গতভাবে।' [৩৩-সূরা আহযাব : ৩২]

৭. নারীদেরকে স্বামী বা মাহরাম কোন পুরুষ ছাড়া একাকী সফর করতে নিষেধ করা হয়েছে। এমনকি হজ্জের উপযোগী হলেও স্বামী বা মাহরাম পুরুষ ব্যতীত হজ্জে যেতে নিষেধ করা হয়েছে

 اللَّهُ عَنْهُمَا، عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: لَا تُسَافِرِ الْمَرْأَةُ ثَلَاثًا إِلَّا مَعَ رَضِيَ عَنِ ابْنِ . ذِي مَحرَم 

“ইবন উমার (রা.) বর্ণনা করেন, নাবী (সা.) বলেন, কোন মহিলা মাহরাম ব্যক্তিকে সাথে না নিয়ে তিন দিনের সফরে যেতে পারবে না।” [বুখারী, কিতাবুস সালাত; মুসলিম, কিতাবুল হাজ্জ]

عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمَا، قَالَ: قَالَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: لَا يَحِلُّ لِامْرَأَةٍ تُؤْمِنُ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ أَنْ تُسَافِرَ مَسِيرَةَ يَوْمٍ وَلَيْلَةٍ لَيْسَ مَعَهَا حُرْمَةٌ

“আবু হুরাইরা (রা.) বলেন, নাবী কারীম (সা.) বলেছেন, আল্লাহ এবং আখিরাতে বিশ্বাসী কোনো নারীর জন্য এক দিন এক রাত সফর করা জায়িয নয়, যদি না তার সাথে কোন মাহরাম ব্যক্তি থাকে।” [প্রাগুক্ত]

৮. মাহরাম পুরুষের উপস্থিতি ব্যতীত নারী-পুরুষের একান্তে সাক্ষাৎকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

عَنْ عُقْبَةَ بْنِ عَامِرٍ: أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ : إِيَّاكُمْ وَالدُّخُولَ عَلَى النِّسَاءِ فَقَالَ رَجُلٌ مِنَ الْأَنْصَارِ : يَا رَسُولَ اللَّهِ ، أَفَرَأَيْتَ الحَمْوَ؟ قَالَ: الْحَمْوُ المَوْتُ ““উকবা ইবন আমির (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, নারীদের নিকট প্রবেশ থেকে তোমরা সাবধান থেকো। আনসারদের জনৈক ব্যক্তি বলল, দেবরের ব্যাপারে আপনার অভিমত কি? তিনি বললেন, দেবর তো যমতুল্য।” [বুখারী, কিতাবুন নিকাহ

عَنِ ابْنِ عَبَّاسِ، عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ : لا يَخلُوَنَّ رَجُلٌ بِامْرَأَةٍ إِلَّا مَعَ ذِي مَحْرَم 

“ইবন ‘আব্বাস (রা.) বর্ণনা করেন, নাবী কারীম (সা.) বলেন, মাহরাম ব্যক্তি ব্যতীত কোনো পুরুষ যেন কোনো পর নারীর সাথে একাকী সাক্ষাৎ না করে। [প্রাগুক্ত]

৯. অনুমতি ব্যতীত অন্যের ঘরে বা বাড়ীতে প্রবেশ করাকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কারণ এতে গৃহাভ্যন্তরে অবস্থানরত নারীদের সঙ্গে পর্দাহীন অবস্থায় সাক্ষাৎ ঘটবে যা মোটেও কাম্য নয়। অধিকন্তু অন্যের গৃহে অবাধে প্রবেশের সুযোগ নারী-পুরুরের অবৈধ সম্পর্ক সৃষ্টিসহ নানা ধরনের অঘটন ঘটানোর অনুঘটক হিসেবে কাজ করে থাকে। এজন্য ইসলাম একে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করেছে। 

কুরআন কারীমে ইরশাদ হয়েছে, 

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لا تَدْخُلُوا بُيُوتًا غَيْرَ بُيُوتِكُمْ حَتَّى تَسْتَأْنِسُوا وَتُسَلِّمُوا عَلَى أَهْلِهَا ذَلِكُمْ خَيْرٌ لَكُمْ لَعَلَّكُمْ تَذَكَّرُونَ

“হে ঈমানদারগণ, তোমরা নিজেদের গৃহ ব্যতীত অন্যের গৃহে প্রবেশ করো না, যতক্ষণ না অনুমতি গ্রহণ কর এবং গৃহবাসীর উপর সালাম প্রদান কর। এটিই তোমাদের জন্য কল্যাণকর, আশা করা যায় যে, এটি তোমরা স্মরণ রাখবে।” [২৪-সূরা আন-নূর: ২৭]

এমন কি নিজের মা-বোনের কাছে যাবার সময়ও অনুমতি নিতে হবে।

عَنِ ابْنِ مَسْعُوْدٍ قَالَ: عَلَيْكُمْ أَنْ تَسْتَأْذِنُوْا عَلَى أُمَّهَاتِكُمْ وَأَخَوَاتضكُمْ. 

“ইবন মাসউদ (রা.) বলেন, তোমাদের মাতা এবং ভগ্নিদের নিকট প্রবেশ করতেও অনুমতি নেওয়া আবশ্যক।” [ইবন কাছীর]

ইবন ‘আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, 

তিনটি আয়াতকে লোকেরা অস্বীকার করে। আল্লাহ বলেন, 'নিশ্চয়ই তোমাদের মধ্যে আল্লাহর নিকট সেই সর্বাধিক সম্মানিত যে আল্লাহকে সবচেয়ে বেশি ভয় করে’ [৪৯-সূরা আল-হুজুরাত : ১৩] অথচ লোকেরা বলে, 'আল্লাহর নিকট সেই বেশি সম্মানী যার বাড়ী সবচেয়ে বড়'। তিনি (ইবন 'আব্বাস) বলেন, অনুমতির বিষয়টি লোকেরা পুরোপুরিই অস্বীকার করে। ‘আতা ইবন আবু রিবাহ বলেন, আমি বললাম, আমার গৃহে আমার ইয়াতিম বোনেরা, যারা আমার সাথে একই বাড়ীতে থাকে, তাদের নিকট প্রবেশ করতেও কি আমি অনুমতি চাইব? তিনি উত্তর দিলেন, হ্যাঁ। আমাকে এর (বিনা অনুমতিতে প্রবেশের) অবকাশ দেওয়ার জন্য পুনরায় বললে, তিনি তা অস্বীকার করে বললেন, তাদেরকে উলঙ্গ দেখতে পছন্দ করবে? আমি বললাম না, তিনি বললেন, তাহলে অনুমতি নাও। ‘আতা বলেন, আমি পুনরায় বিষয়টি উপস্থাপন করলে তিনি বললেন, তুমি কি তুমি কি আল্লাহর আনুগত্য করতে পছন্দ কর? আমি বললাম জী, হ্যাঁ। তিনি বললেন, তাহলে অনুমতি নাও ।” [প্রাগুক্ত]

আতা ইবন ইয়াসার থেকে বর্ণিত, 

“এক ব্যক্তি নাবী (সা.) কে বলল, আমি কি আমার মায়ের কাছে যাবার সময়ও অনুমতি চাইবো? তিনি বললেন, হ্যাঁ। সে বলল, আমি ছাড়া তার সেবা করার আর কেউ নেই। এক্ষেত্রে আমি যতবার যাব ততবার কি তার কাছে অনুমতি নেব? তিনি বললেন, “তুমি কি তাকে উলঙ্গ অবস্থায় দেখতে পছন্দ করো? লোকটি বলল, না। তিনি বললেন, তাহলে তার নিকট যেতে অনুমতি নাও।” [তাফসীরে তাবারী]

১০. দরজা বা জানালা দিয়ে অন্যের গৃহাভ্যন্তরে উঁকি মেরে দেখাও নিষিদ্ধ ।

عَنْ أَبي هُرَيْرَةَ، قَالَ: قَالَ أَبُو القَاسِمِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: لَوْ أَنَّ امْرَأَ اطَّلَعَ عَلَيْكَ بِغَيْرِ إِذْنِ فَفَقَاتَ عَيْنَهُ، لَمْ يَكُنْ عَلَيْكَ جُنَاحٌ فَخَذَفْتَهُ بِعَصَاةٍ

“আবু হুরাইরা (রা.) বর্ণনা করেন, আবুল কাসিম (সা.) বলেন, যদি কোনো ব্যক্তি তোমার অনুমতি ব্যতিত তোমার গৃহে উঁকি দেয়, আর তুমি যদি পাথর নিক্ষেপ করে তার চোখ উপরে ফেল, তাহলে তোমার কোনো দোষ নই।” [বুখারী, কিতাবুদ দিয়াত- ৬৯০]

১১. পর নারী/ পর পুরুষের সঙ্গে মুসাফাহা বা করমর্দন নিষিদ্ধ ইসলামের দৃষ্টিতে গাইরি মাহরাম বা যে সকল নারী-পুরুষের মধ্যে পরস্পরে বিবাহ বৈধ, সে সকল নারী-পুরুষে পরস্পরে মুসাফাহা করা জায়িয নয়। অর্থাৎ এ ধরনের নারীর পুরুষের সঙ্গে এবং পুরুষের নারীর সাথে মুসাফাহা বা করমর্দন জায়িয নয়। শারী'আতের দৃষ্টিতে এটি সম্পূর্ণ নাজায়িয। যারা এ ধরনের মুসাফাহা করবে তারা কবীরা গুনাহের অধিকারী হবে। 

এ ব্যাপারে হাদীছের বর্ণনা অত্যন্ত সুস্পষ্ট।

عَنْ عَائِشَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهَا ، قَالَتْ : " كَانَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يُبَايِعُ النِّسَاءَ بِالكَلامِ بِهَذِهِ الْآيَةِ : لا يُشْرِكْنَ بِاللَّهِ شَيْئًا} [الممتحنة: 12]، قَالَتْ: وَمَا مَسَّتْ يَدُ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَدَ امْرَأَةٍ إِلَّا امْرَأَةً يَمْلِكُهَا "

“আয়িশা (রা.) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) 'তারা (নারীরা) আল্লাহর সাথে কোন কিছু শরীক করবে না'-এ আয়াতের আলোকে নারীদের বাইআত গ্রহণ করতেন কথার দ্বারা। তিনি (‘আয়িশা) বলেন, আল্লাহর রাসূলের হাত কখনো অধিনস্থ কোনো নারী (স্ত্রী বা ক্রীতদাসী) ব্যতীত অন্য কোনো নারীর হাতকে স্পর্শ করেনি।” [বুখারী, কিতাবুল আহকাম-৭২১৪]

“উমাইমা বিনতে রুকাইকা বলেন, 

আমি একদল মহিলার সাথে আল্লাহর রাসূল (সা.) এর নিকট বাইআত করার জন্য আগমন করলাম। তারা (মহিলারা) বলল, হে আল্লাহর রাসূল (সা.) আমরা আপনার নিকট এ মর্মে বাই'আত করছি যে, আমরা আল্লাহর সাথে কোনো কিছুকে শরীক করব না, চুরি করব না, যিনা করব না, আমাদের সন্তানদেরকে হত্যা করব না, আমাদের দু'হস্ত ও পদদ্বয়ের মাঝখান (অন্তর) হতে কারো প্রতি কোনো অপবাদ দিব না এবং কোনো ভাল কাজে আপনার অবাধ্য হবো না। একথা শুনে রাসূল (সা.) বললেন, তোমাদের যতটুকু শক্তি-সামর্থ আছে সে অনুযায়ী তা পালন কর। উমাইমা বলেন, আমি বললাম, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল আমাদের নিজেদের চেয়েও আমাদের প্রতি অধিকতর দয়াশীল। হে আল্লাহর রাসূল (সা.) আসুন, আমরা আপনার নিকট বাই'আত করি। আল্লাহর রাসূল (সা.) বললেন, আমি কোনো মহিলার সাথে কখনো মুসাফাহা করিনা। নিশ্চয়ই আমার কথা একজনের জন্য যেমন প্রযোজ্য তেমনি শত মহিলার জন্যও প্রযোজ্য।” [সুনানুন নাসাঈ, কিতাবুল বায়'আ]

১২. বেহায়াপনা ও অশ্লীলতা নিষিদ্ধ। বেহায়াপনা ও অশ্লীলতা যৌন উত্তেজনা বৃদ্ধি করে মানুষের নৈতিক স্খলন ঘটায় বলে এটিকে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। 

কুরআন কারীমে বলা হয়েছে,

إِ

نَّ الَّذِينَ يُحِبُّونَ أَنْ تَشِيعَ الْفَاحِشَةُ فِي الَّذِينَ آمَنُوا هُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ فِي الدُّنْيَا وَالْآخِرَةِ 

“নিশ্চয়ই যারা মুমিনদের মধ্যে অশ্লীলতা বিস্তারে তৎপর তাদের জন্য দুনিয়া ও আখিরাতে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি রয়েছে। [২৪-সূরা আন-নূর : ১৯ ] 

১৩. যিনা ব্যভিচারে লিপ্ত হলে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা। উপর্যুক্ত প্রতিরোধমূলত ব্যবস্থার পরও যদি কেউ এ জঘণ্যতম কাজে লিপ্ত হয়, তাহলে ইসলাম তাকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়ার ব্যবস্থা করেছে। এ প্রসঙ্গে কুরআন কারীমে বলা হয়েছে,

 اللَّهِ إِنْ كُنْتُمْ تُؤْمِنُونَالزَّانِيَةُ وَالزَّانِي فَاجْلِدُوا كُلَّ وَاحِدٍ مِنْهُمَا مِائَةَ جَلْدَةٍ وَلَا تَأْخُذْكُمْ بِهِمَا رَأْفَةٌ فِي دِينِ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الآخِرِ وَلْيَشْهَدْ عَذَابَهُمَا طَائِفَةٌ مِنَ الْمُؤْمِنِينَ (2)

“ব্যভিচারী নারী ও পুরুষের প্রত্যেককে একশতটি বেত্রাঘাত কর। যদি তোমরা আল্লাহ ও আখিরাত দিবসের প্রতি বিশ্বাসী হয়ে থাক, তাহলে আল্লাহর বিধানের ব্যাপারে তাদের ক্ষেত্রে যেন তোমাদের কোনো অনুকম্পা না জাগে। আর তাদের শাস্তি যেন মুমিনদের একটি দল প্রত্যক্ষ করে।” [২৪-সূরা আন-নূর : ২]

বিবাহিত নারী-পুরুষের ক্ষেত্রে এ দণ্ড আরো কঠোর। এ ধরনের নারী-পুরুষ ব্যভিচারে লিপ্ত হলে তাকে রজম অর্থাৎ পাথর মেরে মৃত্যু দণ্ড দেওয়ার বিধান দেওয়া হয়েছে ৷ এ আলোচনা থেকে বুঝা যায় যে, ইসলাম যিনা-ব্যভিচার থেকে লোকদেরকে বিরত রাখার জন্য কতটা সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে এবং কতটা সর্বাত্মক প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপ নিয়েছে।

নারীদের হিযাব :

উপরোক্ত আলোচনার ২নং ধারায় নারীদেরকে গৃহেই অবস্থান করতে বলা হয়েছে। ৩, ৪, এবং ৫ নং ধারায় বাইরে বের হওয়ার সময় সম্পূর্ণ শরীর ভালভাবে ঢেকে রাখতে, স্বামী বা মাহরাম পুরুষ ব্যতিত অন্য কারো সামনে সৌন্দর্য প্রকাশ না করতে এবং নারীদের নিকট কোনো কিছু চাইতে হলে পর্দার আড়াল থেকে চাওয়ার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এ থেকে বুঝা যায় যে, নারীদের পুরো শরীরই হিযাবের অন্তর্ভূক্ত। স্বামী বা মাহরাম পুরুষ ব্যতিত অন্যদের সামনে পুরো শরীরই ঢেকে রাখতে হবে। শর'ঈ পর্দার শর্তসমূহ :

শর'ঈ পর্দার প্রয়োজনীয় কতিপয় শর্ত রয়েছে। সেগুলো হলো, 

১. পর্দার জন্য কাপড়টি এমন হতে হবে, যা পুরো শরীরকে ভালভাবে ঢেকে দেবে। পুরো শরীর না ঢাকলে তা শর'ঈ পর্দা বলে গণ্য হবে না।

২. পর্দার জন্য ব্যবহৃত কাপড়টি মোটা হতে হবে। কারণ পর্দার উদ্দেশ্য হলো ঢেকে রাখা। যদি কাপড়টি এমন পাতলা হয়, যা দৃষ্টিকে বাধাগ্রস্ত করতে সক্ষম নয় অর্থাৎ যে কাপড়ের মধ্য দিয়ে শরীর দেখা যায়, এমন কাপড় পরিধান করলে তা শর'ঈ পর্দা বলে গণ্য হবে না ।

৩. কাপড়টি উজ্জল রং এর, চকচকে ও এমন সুন্দর না হওয়া, যা পর পুরুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। কারণ পর পুরুষের দৃষ্টি থেকে সৌন্দর্যকে ঢেকে রাখার জন্যই পর্দা। এখন পর্দা যদি নিজেই আকর্ষণীয় হয়, তাহলে তা অন্যের আকর্ষণ না ঠেকিয়ে বরং অন্যকে আরো আকৃষ্ট করবে। সুতরাং তা পর্দা হিসেবে গণ্য হবে না ।

৪. তা হতে হবে ঢোলা-ঢালা। আট-সাট ও সংকীর্ণ হলে চলবে না। কারণ তাহলে তা শরীরের সাথে এটে থাকবে এবং তাতে দেহের বিভিন্ন অঙ্গের আকার-আকৃতি বুঝা যাবে, যা আকর্ষণ সৃষ্টি ও ফিত্নার কারণ হতে পারে। সুতরাং কাপড়টি এমন ঢোলা-ঢালা হতে হবে, যাতে বাইরে থেকে শরীরের আকার-আকৃতি বুঝা না যায় । 

৫. কাপড়টি সুগন্ধিযুক্ত হওয়া চলবে না। কারণ তা পুরুষদেরকে আকৃষ্ট করে। 

৬. কাপড়টি পুরুষদের কাপড়ের সদৃশ হতে পারবে না অথবা যে সকল কাপর পুরুষদের পরিধানের জন্য নির্দিষ্ট সে সকল কাপড় হতে পারবে না । [মুহাম্মদ আলী আস সাবুনী, রাওয়ায়িউল বায়ান তাফসীরু আয়াতিল আহকাম মিনাল কুরআন, সুরা আহযাব, ৫৯ নং আয়াতের তাফসীর]

নারীদের মুখমন্ডলও পর্দার অন্তর্ভূক্ত। মাহরাম ব্যতীত অন্য পুরুষের সামনে এবং কোন প্রয়োজনে বাড়ীর বাইরে যাওয়ার সময় যদি পুরুষের সামনা-সামনি হতে হয়, তাহলে সে ক্ষেত্রে শরীরের অন্যান্য অংশের মত চোখ ব্যতীত নারীদের পূর্ণ মুখমন্ডল ঢেকে রাখা আবশ্যক। অবশ্য সালাত আদায়ের সময় নারীদের মুখ, দু'হাতের কব্জি পর্যন্ত এবং পায়ের গোড়ালি খোলা রাখার অনুমতি আছে। সামাজিক শৃংখলা বজায় রাখা, অশ্লীলতা রোধ করা ও নারীদের নিরাপত্তার জন্যই এ সকল সতর্কতামূলক ব্যবস্থার প্রবর্তন করা হয়েছে। 

যে নারীরা এ সকল ব্যবস্থার ব্যত্যয় ঘটায় তারা মূলত: সামাজিক শৃংখলা বিনষ্ট করে, অশ্লীলতার প্রসার ঘটায় এবং নিজেদের ও অন্যান্য নারীদের ইজ্জত-আব্রু ও জীবনের নিরাপত্তার বিঘ্ন ঘটায়। ইভ টিজিং, শ্লীলতা হানি, ধর্ষণ, ধর্ষণোত্তর হত্যা প্রভৃতির জন্য নারীদের উচ্ছৃংখলভাবে চলাফেরাও অনেকাংশে দায়ী। কারণ যুব মহিলাদের এধরনের উচ্ছৃংখল চলাফেরা বখাটে যুবকদের আকৃষ্ট করে। এ জন্য ইসলাম পর্দার বিধান লঙ্ঘন করাকে গুরুতর অপরাধ হিসেবে গণ্য করেছে এবংযারা এ অপরাধে লিপ্ত হবে, তাদের জন্য কঠিন শাস্তির হুশিয়ারী দিয়েছে। 

মুসলিম নারীদের জন্য পর্দা একটি ফরজ ইবাদাত :

এটি পালন করলে তারা ফরজ “ইবাদাতের ছওয়াব পেতে থাকবে। পক্ষান্তরে পর্দার বিধান পালন না করলে ফরজ লঙ্ঘনের দায়ে প্রতিনিয়ত কবীরা গোনাহের অধিকারী হতে থাকবে। পর্দা প্রতিপালনের মাধ্যমে মুসলিম নারীগণ জান্নাত লাভের সৌভাগ্য অর্জন করতে পারেন। অপরদিকে পর্দা লঙ্ঘন করলে জান্নাত থেকে বঞ্চিত হতে হবে এবং জাহান্নামে যেতে হবে

ঐ সকল নারী যারা কাপড় পরেও উলঙ্গ 

অর্থাৎ এমন পোষাক পরে, যাতে পূর্ণ শরীর আচ্ছাদিত হয়না, বরং শরীরের কিছু কিছু অংশ খোলা থাকে অথবা এমন পাতলা কাপড় পরে, যাতে কাপড়ের ভিতর দিয়ে শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দেখা যায়, তাদেরকে হাদীছে কাপড় পরা স্বত্বেও উলঙ্গ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। কারণ এধরনের পোষাক পরা দ্বারা সতর ঢাকা বা পর্দা করা হয়না। যারা আকর্ষণীয় পোষাক পরে, নানা রকম সাজসজ্জা করে, অঙ্গ সৌষ্ঠব প্রকাশ করে অথবা বিভিন্ন অঙ্গ ভঙ্গির মাধ্যমে অন্যকে আকৃষ্টক করে, তারাও পর্দা লঙ্ঘন করে। যারা অহংকারের ভঙ্গিতে হেলে-দুলে পথ চলে এবং যারা মাথার চুলকে উটের কুঁজের মত উঁচু করে খোপা বেধে পর পুরুষের সামনে চলাফেরা করে, তারাও পর্দা লঙ্ঘন করে। 

এ ধরনের নারীরা জান্নাতে যাওয়া তো দূরের কথা, জান্নাতের ঘ্রাণও পাবে না। অর্থাৎ তারা হবে জাহান্নামী। উল্লেখিত হাদীছে এ কথাই বলা হয়েছে। সুতরাং মুসলিম নারীদেরকে এ বিষয়ে সতর্ক হতে হবে। তাদেরকে পোষাক ও চলাফেরার ব্যাপারে ইসলামের নীতিমালা মেনে চলতে হবে। তাহলেই তারা সৌভাগ্যবতি হবে এবং জান্নাত লাভের সৌভাগ্য অর্জন করতে পারবে। 

পোস্ট ট্যাগ :
refinance | housing finance companies | us bank refinance | ১৭ শ্রেণির লোক জান্নাতে যাবে না | কিয়ামতের দিন মানুষ কয়ভাগে বিভক্ত হবে? | জাহান্নাম | ছয় প্রকার নারী জাহান্নামে যাবে | জাহান্নাম হয়ে জান্নাতে যাবেন যারা | জান্নাত ও জাহান্নামের | তিন শ্রেণীর মুছল্লী জাহান্নামে যাবে।


Post a Comment

Previous Post Next Post