উদার মতাবলম্বী শিক্ষার ব্যর্থতা | Shikkhar Berthota

আজকের উদার মতাবলম্বী শিক্ষা পূর্বে আলোচিত দৃষ্টিভংগীর বিরোধী। গোড়ার দিকে সেটাই উদার মতাবলম্বী শিক্ষা ছিলো যেটা একজন স্বাধীন মানুষের জন্যে উপযুক্ত বলে বিবেচিত হতো এবং দাস বা ভূমিদাসের জন্যে প্রচলিত শিক্ষার চেয়ে যা পৃথক ছিলো । গ্রীক এবং রোমানগণ উদার শিল্পকলার চর্চা কেবলমাত্র স্বাধীন নাগরিকদের জন্যেই উপযুক্ত বলে মনে করতো । মধ্য যুগেও এ মত প্রচলিত ছিলো। লিবারেল আর্টস দু' ভাগে বিভক্ত ছিলো : Trivium এবং Quadrivium। প্রথম ভাগের ছিলো ব্যাকরণ, অলংকার শাস্ত্র ও তর্কশাস্ত্র। দ্বিতীয় ভাগে ছিলো অংক শাস্ত্র, জ্যামিতি ; জোতির্বিদ্যা ও ; সংগীত।


আধুনিককালে উদার মতাবলম্বী শিক্ষা উদ্দেশ্যমূলক এবং আদর্শের প্রতি নিরপেক্ষ হয়ে পড়ে। অন্য সব বিবেচনার বিপক্ষে ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যের উপর জোর দেয়া হলো। শিক্ষাকে ধর্ম ও নৈতিক মূল্যবোধ থেকে পৃথক করা হলো। স্বাধীনতাই হলো শেষ কথা। বিষয় ও পাঠ্যসূচীতে নৈর্বাচনিক ব্যবস্থা প্রবর্তিত হলো। এ বিষয়ে অত্যন্ত গুরুত্ব দেয়া হলো যে, একজন ছাত্রকে তার সুপ্ত প্রতিভার বিকাশ ও উন্নত করার জন্যে যথেষ্ট স্বাধীনতা দিতে হবে এবং তার চিন্তাধারা চরিত্রকে বিশেষ ছাঁচে গড়ে তোলার জন্যে বাইরের প্রভাব বিস্তার করা যাবে না। এ ধরনের শিক্ষা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বহুল প্রচলিত এবং অনেক ইউরোপীয় দেশেও তা সমাদৃত হয়েছে।


উদার মতাবলম্বী শিক্ষা যে ফল উৎপাদন করেছে তা মোটেই উৎসাহ ব্যঞ্জক নয়। গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি পরিণতি নিম্নে বর্ণিত হচ্ছে :

Shikkhar Berthota

(ক) এ শিক্ষা ছাত্রদের মধ্যে সামাজিক দৃষ্টি বা ধারণা সৃষ্টি করতে ব্যর্থ হয়েছে। যখন কোনো জাতি তাদেরকে ত্যাগ ও কর্মে উদ্দীপিত করার মতো আদর্শের অভাবে পড়ে তখন ক্রমশ তারা ইতিহাসের ওপর তাদের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে এবং তাদের পতন শুরু হয় । আল্লামা ইকবাল বলেন : “একজন ব্যক্তির জীবন নির্ভর করছে আত্মা ও দেহের সম্পর্কের ওপর । জাতির জীবন নির্ভর করছে তার ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির সংরক্ষণের ওপর। জীবন প্রবাহ বন্ধ হলে ব্যক্তি মারা যায় । জাতি মৃত্যুবরণ করে যদি তার আদর্শ পদদলিত হয়।”

(খ) এ শিক্ষা নতুন জেনারেশনের আত্মা ও অন্তরে নৈতিক মূল্যবোধ প্রবেশ করাতে ব্যর্থ হয়। মনের চাহিদা পূরণ নিয়েই সে ব্যস্ত। আত্মার চাহিদার প্রতি তা উদাসীন। এ দু'য়ের মাঝে একটা বিচ্ছেদ সৃষ্টি হয়। এ পরিণতিতে একটা জাতির ক্ষতি আত্মপ্রকাশ করে


আল্লামা ইকবাল বলেন :


“জ্ঞান যদি তোমার দেহের সমৃদ্ধির জন্যে ব্যবহৃত হয়, তবে সে জ্ঞান তোমার জন্যে বিষধর সাপ । জ্ঞান যদি তোমার আত্মার মুক্তির জন্যে ব্যবহৃত হয়, তবে তা তোমার সর্বোত্তম বন্ধু।”


(গ) এ শিক্ষার অন্যতম পরিণতি জ্ঞানের বিভাগীয় পৃথকীকরণে। উদার শিক্ষা জ্ঞানকে সমন্বিত করে পূর্ণাংগ এককে পরিণত করতে ব্যর্থ হয়েছে। ছাত্রগণ ছোট ও অসংগত টুকরোরূপে জগতকে দেখে ও বিভিন্ন টুকরো তথা বিভাগীয় জ্ঞানের সমন্বয় সাধন করে এবং অন্তর্নিহিত তাৎপর্য হৃদয়ংগম করতে ব্যর্থ হয়। তারা গাছ দেখে কাঠ দেখে না ৷


(ঘ) এ শিক্ষা এমন সব লোক সৃষ্টি করে জীবনের মৌলিক ও জরুরী বিষয়গুলোর ওপর যাদের সুগভীর পাণ্ডিত্য থাকে না। বস্তুত তাদের জ্ঞান অত্যন্ত অগভীর এবং একে অভিজ্ঞতা লব্ধ গভীর জ্ঞান বলে বিবেচনা করা চলে না। জাতীয় দৃষ্টিভংগীতে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় এ শিক্ষা ঈন্সিত ফলোৎপাদন করতে ব্যর্থ হয়েছে।


আধুনিক উদার শিক্ষার দুর্বলতাগুলো ক্রমশ প্রকাশ হয়ে পড়ছে। Dr. Frank Advlotte আমেরিকার শিক্ষা সম্বন্ধে বলেছেন : “লক্ষের বিপরীতে কেবলমাত্র কলা-কৌশল ও পদ্ধতি নিয়ে তন্ময়তা সাহিত্য অথবা দর্শন অথবা ইতিহাস অথবা ধর্ম অধ্যয়নকে ‘উদার উপাদান' হতে বঞ্চিত করছে।”


বিখ্যাত সমাজ দার্শনিক Walter Lippman তাঁর The State of Education in this Troubled World নামক ভাষণে বলেছেন :


“স্কুল এবং কলেজসমূহ কর্মজগতে এমন সব লোক প্রেরণ করছে যারা সমাজের সৃজনশীল নীতিগুলো আর বুঝছে না। নিজেদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বঞ্চিত নব্যশিক্ষিত পাশ্চাত্য ব্যক্তিবর্গ আকার এবং সারবত্তার দিক থেকে তাদের মনের গভীরে পাশ্চাত্য সভ্যতার ধ্যান-ধারণা, তার্কিক প্রস্তাব, মৌলিক যুক্তি, যুক্তি-তর্ক এবং পদ্ধতি ধারণ করছে না। বর্তমান শিক্ষা, অপরিবর্তনীয়ভাবে চলতে থাকলে পাশ্চাত্য সভ্যতাকে ধ্বংস করে দেবে। বস্তুত সে একে ধ্বংস করে চলছে।”

Institute of International Education-এর সহ-সভাপতি, Dr. Albert G. Sims তাঁর এক নিবন্ধে লিখেছেন :

“মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শিক্ষার প্রধান সমস্যা হচ্ছে—অন্যান্য সবগুলো হচ্ছে স্পর্শক-সংজ্ঞা দান এবং লক্ষ্য ও দর্শনকে কার্যকরী রূপ দান। একথাটা বলাই এর জবাব নয় যে, শিক্ষা ব্যবস্থা তো যে সমাজের জন্যে রচিত সে তার ছবিই প্রতিবিম্বত করবে। শিক্ষা এমন একটি উপায় যার মাধ্যমে একটি সম্প্রদায় স্বেচ্ছায় তার ভবিষ্যত দৃষ্টিভংগী বা মনোভাব অবশ্যই তুলে ধরবে।

যুক্তরাষ্ট্রের শিক্ষা' সম্বন্ধে রকেফেলার রিপোর্ট স্পষ্টভাবে এ ঘাটতি তুলে ধরছে : “তারা (ছাত্রগণ) তাদের জীবনের অর্থ খুঁজে পেতে চায় । তাদের যুগ, তাদের সংস্কৃতি এবং তাদের নেতৃবৃন্দ যদি তাদেরকে উন্নত অর্থ, মহান লক্ষ এবং শ্রেষ্ঠ প্রত্যয় দিতে না পারে, তাহলে তারা অগভীর ও তুচ্ছ অর্থের ওপরেই ভর করবে। যেসব ব্যক্তি নিরুদ্দেশ জীবন যাপন করে, যারা তাদের জীবনের অর্থের অন্বেষণকে অসাধু এবং মিথ্যা আড়ম্বরযুক্ত অভিজ্ঞতা দ্বারা পরিতৃপ্ত রাখতে চায় তারা আসলে কোনো বিকল্প অর্থ দ্বারা আন্দোলিত-ই হয়নি—আন্দোলিত হয়নি ধর্মীয় অর্থ, নৈতিক মূল্যবোধ, সামাজিক ও নাগরিক দায়িত্ববোধ এবং আত্মোপলব্ধির উন্নত মূল্যমান দ্বারা। এটা এমন এক অভাব যার জন্যে আমরা সবাই দায়ী।”


আমাদের মেনে নিতে হবে যে,

“শিক্ষা এমন এক প্রক্রিয়া যার মধ্যে অর্থ ও উদ্দেশ্য অবশ্যই প্রবেশ করাতে হবে, প্রত্যেককে গভীরভাবে প্রত্যয় আঁকড়িয়ে ধরতে হবে এবং প্রত্যেক যুবককে সে মূল্যবোধ এর স্বার্থ সংরক্ষণে ব্রতী হতে হবে যা তাকে লালন করেছে, তাকে শিক্ষাদান করেছে এবং একজন ব্যক্তি হিসেবে তাকে স্বাধীনতা উপভোগের সুযোগ দিয়েছে।

The crisis in the Universities Sir Walter Moberly লিখেছেন :

“আমাদের সংকট এই যে, বেশীর ভাগ ছাত্রই আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অধ্যয়ন করে চলছে, অথচ সত্যিকার গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর দিকে তাদের মন সংযোগ করছে না। শিক্ষা পরিবেশের নিরপেক্ষতার প্রভাবে তারা সূক্ষ্মভাবে সামাজিক ও রাজনৈতিক স্থিতাবস্থার প্রতি মৌন সম্মতি প্রদানের দীক্ষা পাচ্ছে। দীক্ষা পাচ্ছে ধর্মনিরপেক্ষতার, যার ওপর গভীরভাবে চিন্তা করার অবকাশ তাদের ঘটেনি । জ্ঞানের বিভক্তিকরণের ফলে জীবন উদ্দেশ্যের দায়িত্ব নির্ধারণের চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন তারা হচ্ছে না। আবার বিজ্ঞজনোচিতভাবে এ ধরনের সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রস্তুতিও তাদের নেই। মূলত তারা অশিক্ষিতই থেকে যাচ্ছে।

শিক্ষা সামগ্রিক পরিপ্রেক্ষিতে পর্যালোচনা করে Professor Harold H. Titas লিখেছেন : “সাধারণ জ্ঞান-ভাণ্ডারের অভাবের চেয়েও অধিকতর মারাত্মক হচ্ছে সাধারণ আদর্শ ও প্রত্যয়ের অনুপস্থিতি। শিক্ষা সত্যাপন, দৃঢ় বিশ্বাস ও নিয়মানুবর্তিতা শেখাতে বার বার ব্যর্থ হচ্ছে। মানবিক মূল্যবোধ এবং বাধ্যতা থেকে বিজ্ঞান ও গবেষণা বিপজ্জনকভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে।... শিক্ষা অতিতের আধ্যাত্মিক ঐতিহ্য থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে নিয়েছে এবং তদস্থলে বিকল্প মূল্যবোধ প্রদান করতেও ব্যর্থ হয়েছে। পরিণামে শিক্ষিত লোকেরাও আজ দৃঢ় বিশ্বাস বঞ্চিত। বঞ্চিত মূল্যবোধ থেকে। আর বঞ্চিত একটি সুসংহত বিশ্বদর্শন থেকে ।”


M. V. C. Jaffreys অভিযোগ করে লিখেছেন :

আধুনিক শিক্ষা পদ্ধতির সবচেয়ে বেশী মারাত্মক দুর্বলতা হচ্ছে এর লক্ষের অনিশ্চয়তা। ইতিহাসের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই প্রাণবন্ত ও কার্যকরী শিক্ষা-ব্যবস্থা- সমূহ এদের লক্ষ ও উদ্দেশ্য সুস্পষ্টভাবে বিবেচনা করেছে ব্যক্তিগত গুণাবলী ও সমাজ পরিবেশের পরিপ্রেক্ষিতে।

স্পার্টান, ফিউডাল, জ্যাসুইট, নাৎসী এবং কম্যুনিষ্ট শিক্ষাবিদগণ এ বিষয়ে একমত। তাঁরা তাঁদের কর্তব্য সম্বন্ধে অবগত এবং তাঁদের করণীয় সম্বন্ধে তাঁদের বিশ্বাসও আছে। বিপরীত পক্ষে, উদার গণতান্ত্রিক দেশসমূহের শিক্ষার লক্ষ দুঃখজনকভাবে অস্পষ্ট। এ চিন্তা প্রবাহ সুস্পষ্টভাবে দেখাচ্ছে যে, শিক্ষা ক্ষেত্রে আদর্শিক নিরপেক্ষতার মতবাদ ভাটার মুখে এবং নিশ্চিতভাবেই এ মতবাদ সাংস্কৃতি ও প্রগতির পক্ষে ক্ষতিকর।



পোস্ট ট্যাগ :
শিক্ষাব্যবস্থার ব্যর্থতা, যে শিক্ষা শিক্ষিত করতে ব্যর্থ হচ্ছে, সফলতা ও ব্যর্থতার পর্যালোচনা, শিক্ষাব্যবস্থার বিবর্তন ও ভবিষ্যৎ, শিক্ষার অবনতি, শিক্ষার সমস্যা ও সমাধান, প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থা শিক্ষার্থীদের মানসিকতায় নতুনত্ব আনতে ব্যর্থ , housing loan, better refinance rates, house mortgage loan, us bank refinance, housing finance companies, wells fargo refinance


Post a Comment

Previous Post Next Post