অধ্যাপক মুজিবুর রহমান
আমাদের আসল রোগ ও এর প্রতিকার :
রাসূলুল্লাহ সা. একদিন হজরত মুআজ রা.-কে অসিয়ত করে বলেন, 'সাবধান! নিজেকে গুনাহ থেকে বিরত রেখো! কারণ, গুনাহ করলে আল্লাহর গজব নাজিল হয়।' (মুসনাদে আহমাদ) তিনি আরও বলেন, 'আমি তোমাদের আসল রোগ এবং খাঁটি ওষুধের কথা বাতলে দিচ্ছি । তোমাদের আসল রোগ হলো ‘গুনাহ' আর খাঁটি ওষুধ হলো তওবা করা।' (বায়হাকি) । রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন: ‘ঐ ব্যক্তি হঠকারী নয় যে ক্ষমা প্রার্থনা করতেই থাকে যদিও তার দ্বারা দিনে সত্তরবারও পাপকার্য সাধিত হয় । এরপর আল্লাহ তায়ালা বলেন, তারা জানে । অর্থাৎ তারা জানে যে, আল্লাহ তায়ালা তওবা কবুলকারী। মুসনাদ-ই-আহমাদে রয়েছে, রাসূলুল্লাহ সা. মিম্বরের উপর বর্ণনা করেন, হে জনমণ্ডলী! তোমরা অন্যদের উপর দয়া প্রদর্শন কর, আল্লাহ তোমাদের প্রতি দয়া করবেন। হে লোকসকল! তোমরা অন্যদের অপরাধ ক্ষমা কর, আল্লাহ তোমাদের পাপসমূহ মার্জনা করবেন।
আল্লাহ যে ব্যাক্তির ওপর খুশি হন :
রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন, 'হে মানবজাতি! তোমরা আল্লাহর কাছে তোমাদের গুনাহের জন্য তওবা করো এবং তাঁর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করো । আমার প্রতি লক্ষ করো! আমি প্রত্যহ শতবার করে আল্লাহর কাছে তওবা করে থাকি ।' (মুসলিম) । রাসূলুল্লাহ সা. আরও বলেছেন, বান্দাহ গুনাহ করার পর তওবা করলে আল্লাহ সে ব্যক্তির ওপর ওই ব্যক্তির চেয়ে অধিক খুশি হন যে ব্যক্তি নিজের জীবিকা নির্বাহের একমাত্র উট কোনো ময়দানে হারিয়ে যাওয়ার পর তা হঠাৎ পেয়ে গেলে খুশি হয়।' (বুখারি ও মুসলিম) । তাই বিগত বছরের ও বিগত জীবনের জানা-অজানা গোপন প্রকাশ্য ছোট বড় ইচ্ছাকৃত অনিচ্ছাকৃত সকল প্রকার গুনাহ থেকে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার কাছে ক্ষমা চাইতে হবে । তিনি অত্যন্ত ক্ষমাশীল ও দয়াবান। আমরা যেন ইসলামের অত্যাবশ্যকীয় শরিয়তের সব বিধি-বিধান ও অনুশাসন যথাযথভাবে মেনে চলে তওবা ও ইস্তেগফারের মাধ্যমে জাহান্নাম থেকে নাজাত লাভ করতে পারি! হে আল্লাহ! পাপকাজ করার পরপরই যাতে আপনার কাছে তওবা করতে পারি, সেই তাওফিক দান করুন!'
আদম ও হাওয়া (আ) :
আদম (আ) ও হাওয়া (আ) থেকে আমাদের শিখতে হবে, বলতে হবে- আদম (আ) ও হাওয়া (আ) দোয়া করেছিলেন “হে আমাদের রব! আমরা নিজেদের ওপর জুলুম করেছি। এখন যদি তুমি আমাদের ক্ষমা না করো এবং আমাদের প্রতি রহম না করো, তাহলে নিঃসন্দেহে আমরা ধ্বংস হয়ে যাবো।' (সূরা আরাফ : ২৩)। নবী সা. এ সম্পর্কে দোয়া করেছেন: “হে আল্লাহ! আমি তোমার রহমতের আশা করি। কাজেই এক মুহূর্তের জন্যও আমাকে আমার নিজের হাতে সোপর্দ করে দিয়ো না।”
শয়তান ও মানুষ (মুমিন) এর পার্থক্য :
শয়তান নিজের ভুল স্বীকার করে বন্দেগির দিকে ফিরে আসার পরিবর্তে নাফরমানির ওপর আরো বেশি অবিচল হয়ে যায়। অন্যদিকে মানুষ নিজের ভুল বুঝতে পারার সাথে সাথেই লজ্জিত হয়ে পড়ে নিজের ত্রুটি স্বীকার করে, বিদ্রোহ থেকে আনুগত্যের দিকে ফিরে আসে এবং ক্ষমা প্রার্থনা করে নিজের রবের রহমতের ছত্রছায়ায় আশ্রয় খুঁজতে থাকে, তাকে তওবা করার সুযোগ দেওয়া হয়। কিরামান কাতিবিন (ফেরেশতা) আমাদের কারো গুনাহ লিখার পূর্বে আল্লাহ আমাদেরকে তওবার ব্যাপারে অনেক সুযোগ দেন। রাসূলুল্লাহ সা. বলেন: নিশ্চয় বামপাশের ফেরেশতা কলম উঠিয়ে অপেক্ষায় থাকে ছয় ঘণ্টা পর্যন্ত গুনাহকারী মুসলিম বান্দার জন্য। বান্দা যদি অনুতপ্ত হয় এবং আল্লাহর নিকট ক্ষমা চায় তাহলে তা মাফ করে দেওয়া হয়, নতুবা একটি গুনাহ লিখা হয়। (তাবারানি, বায়হাকি, ইমাম আলবানী হাদিসটিকে হাসান বলে অভিহিত করেছেন) আরেকটি অবকাশ লিখার পরে এবং মৃত্যু উপস্থিত হওয়া পর্যন্ত দেওয়া হয়। হজরত আনাস রা. হতে বর্ণিত- তিনি বলেন, তোমরা এমন সব কাজ কর যা তোমাদের দৃষ্টিতে চুলের চেয়েও সূক্ষ্ম। কিন্তু আমরা রাসূলুল্লাহর যুগে এগুলোকে মনে করতাম ধ্বংসকারী।
ছোট্ট ছোট্ট গুনাহ হতে বাঁচতে হবে :
হজরত ইবনে মাসউদ রা. তায়ালা হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, একজন মুমিন গুনাহকে এভাবে দেখে থাকে যে, সে যেন এক পাহাড়ের নিচে বসে আছে যা তার মাথার উপর ভেঙে পড়বে। পক্ষান্তরে পাপী তার গুনাহকে দেখে যেন মাছি তার নাকের ডগায় বসেছে, তাকে এভাবে তাড়িয়ে দেয়। এক বর্ণনায় এসেছে যে, “তোমরা নগণ্য ছোট ছোট গুনাহ থেকে সাবধান হও; কেননা সেগুলো মানুষের কাঁধে জমা হতে থাকে অতঃপর তাকে ধ্বংস করে দেয়।' (মুসনাদে আহমদ, সহিহ আল জামে-২৬৮৬- ২৬৮৭)। এটি তাদের জন্য যারা বিশ্বাস করে মহান আল্লাহর এ বাণীকে- ‘আপনি আমার বান্দাদের জানিয়ে দিন যে, নিশ্চয় আমিই একমাত্র ক্ষমাকারী দয়ালু।” (সূরা হিজর : ৪৯)।
তওবার শর্ত হচ্ছে- পূর্বে যা ঘটে গেছে সে জন্য অনুতপ্ত হতে হবে। পুনরায় পাপ কাজে ফিরে না আসার জন্য দৃঢ় সঙ্কল্প গ্রহণ করতে হবে। প্রাপকদের হক ফিরিয়ে দেওয়া ও তাদের নিকট থেকে মাফ চেয়ে নিতে হবে। ‘তোমরা তোমাদের প্রভুর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা কর। অতঃপর তাঁর দিকে প্রত্যাবর্তন (তওবা) কর।” (সূরা হুদ : ৩)
শুধুমাত্র আল্লাহর জন্য পাপ ত্যাগ করা :
তাকে তওবাকারী বলা যাবে না, যে ব্যক্তি পাপ ত্যাগ করল তার শক্তি ও স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য। যেমন; কেউ যিনা করা ত্যাগ করলো যেন দুরারোগ্য ব্যাধি থেকে বাঁচতে পারে অথবা তার শরীর ও স্মৃতিশক্তিকে দুর্বল না করে। তাকে তওবাকারী বলা যাবে না, যে ব্যক্তি চুরি করা ছেড়ে দিয়েছে; কোনো বাড়িতে ঢুকার পথ না পেয়ে বা সিন্দুক খুলতে অসমর্থ কিংবা পাহারাদার ও পুলিশের ভয়ে। তাকে তওবাকারী বলা যাবে না, যে দুর্নীতি দমন বিভাগের লোকজনদের জোর তৎপরতায় ধরা পড়ার ভয়ে ঘুষ খাওয়া বন্ধ রেখেছে। আর তাকেও তওবাকারী বলা যাবে না, যে ব্যক্তি মদ পান, মাদকদ্রব্য বা হেরোইন সেবন ইত্যাদি ছেড়ে দিয়েছে দারিদ্রের কারণে। তেমনিভাবে তাকেও তওবাকারী বলা যাবে না, যে সামর্থ্যহীন হওয়ার কারণে গুনাহ করা ছেড়ে দিলো। যেমন মিথ্যা বলা ছেড়ে দিয়েছে তার কথায় জড়তা সৃষ্টি হওয়ার কারণে কিংবা যিনা করছে না যেহেতু সে সহবাস ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে, কিংবা চুরি করা ছেড়ে দিয়েছে আহত হয়ে পঙ্গু হয়ে পড়ার কারণে ।
রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন: ‘অনুতপ্ত হওয়াই হলো তওবা।' (আহমাদ, ইবনে মাজাহ, সহিহ আল জামে-৬৮০২) তওবা করতে দেরি করা পাপ- যার জন্য তওবার প্রয়োজন সে যেন তাড়াতাড়ি তওবা করে। কারণ তওবা করতে দেরি করাটাই পাপ। আল্লাহর হক যা ছুটে গেছে তা যথাসম্ভব আদায় করা। যেমন জাকাত দেওয়া যা সে পূর্বে দেয়নি। কেননা এতে আবার দরিদ্র লোকজনের অধিকারও রয়েছে।
পাপের স্থান ত্যাগ করা :
পাপের স্থানকে ত্যাগ করা যদি সেখানে অবস্থান করলে আবার সে পাপে জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা থাকে। যারা পাপ কাজে সহযোগিতা করে তাদেরকে পরিত্যাগ করা (১০০টি লোক হত্যাকারীর হাদিস থেকে গ্রহণ করা হয়েছে)। মহান আল্লাহ বলেন: 'আন্তরিক বন্ধুরাই সেদিন একে অপরের শত্রুতে পরিণত হবে, মুত্তাকিরা ছাড়া।' (সূরা যুখরুফ : ৬৭) খারাপ সাথিরা একে অপরকে কিয়ামতের দিন অভিশাপ দিবে ।
হারাম জিনিসকে নষ্ট করে ফেলা- নিজের কাছে রক্ষিত হারাম জিনিসকে নষ্ট করে ফেলা। যেমন মাদক দ্রব্য, বাদ্যযন্ত্র, যেমন একতারা, হারমনিয়াম, অথবা ছবি, ব্লু ফিল্ম, অশ্লীল নভেল নাটক। এগুলো নষ্ট করে ফেলতে হবে অথবা পুড়িয়ে ফেলতে হব। নবী করীম সা. বলেছেন: “যে ব্যক্তি আল্লাহর নিকট তওবা করবে গড়গড়া উঠার পূর্বে, আল্লাহ তার তওবা কবুল করবেন। (আহমাদ, তিরমিজি, সহিহ আল জামে'-৬১৩২) অপর হাদিসে তিনি বলেন: “যে ব্যক্তি পশ্চিম দিক থেকে সূর্য উঠার পূর্বে তওবা করবে, আল্লাহ তায়ালা তার তওবা কবুল করবেন।' (মুসলিম)
সিজদাবনত হয়ে তওবার মাধ্যমে শুরু হোক এবারের রামাদান। পূর্বের সকল গুনাহের কাফফারা হোক এবারের রামাদান এবং সেইসাথে পুনরায় গুনাহ না করার শপথ নেওয়ার মাস হোক এবারের রামাদা। এ মাসে বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে রামাদানের মূল শিক্ষা থেকে দূরে সরে গিয়ে ইবাদতের পরিবর্তে বাহারি রকমের সকল খাবারের জমকালো আয়োজনে মেতে উঠে অনেকে। একজন ঈমানদার নর- নারীর প্রতিটি দিন-রাত প্রতিটি দিন-ক্ষণ তার জন্য মূল্যবান । এই রামাদানে আমাদের দায়িত্ব হলো অনুশোচনা ও আত্মসমালোচনা করে জীবনের বাকী সময়ের জন্য কল্যাণ কামনা করত: সিজদাবনত হওয়া। তওবাহ, ইস্তেগফার, দোয়া- দরুদ, নফল নামাজসহ ইত্যাদি ভালো কাজের মধ্যে রমাদান পালন করা। আসুন ফিরে আসি রবের দিকে খাটি তাওবার মাধ্যমে পাপগুলো ক্ষমা করে নিয়ে জান্নাতের উপযোগী মানুষ হিসেবে নিজেদেরকে তৈরি করাতে কাজে লাগায় এবারের রামাদান কে।
সাবেক সংসদ সদস্য ও ইসলামী চিন্তাবিদ
পেশ কালাম | তাওবার শর্ত ও ইহার পরিপূরক বিষয় | এটা আপনার জন্য আল্লাহর | হায়! ক্ষণস্থায়ী এ জীবনের জন্য কত কিছুই না করি | আল্লাহর জন্য কাউকে ভালবাসা | আমলনামায় যে পাপ লেখা হয় না | তাওবার ঘটনা | তাওবা কবুলের ঘটনা | তাওবার শর্ত কয়টি | housing loan | better refinance rates | house mortgage loan | us bank refinance | housing finance companies | wells fargo refinance.
Post a Comment