মৃত্যুর জন্য ও মৃতদের জন্য করণীয় mrittur jonno koroniyo

অধ্যাপক মুজিবুর রহমান

প্রত্যেক প্রাণীকেই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতেই হবে, এ কথা নাস্তিক আস্তিক নিমিষে সকলেই বিশ্বাস করে কারণ এটার আমরা সকলেই প্রর্ত্যক্ষদর্শী। চাইলেও এই মহাসত্য কে অস্বীকার করার কোন উপায় আমাদের নেই। মুমিন মাত্রই বিশ্বাস করে মৃত্যুর পরবর্তী অনন্তকালীন জীবন কে। তাই আমাদের সকলেরই উচিত মৃত্যুর পরবর্তী জীবন কে সুন্দর করতে প্রচেষ্টা চালানো বা কাজ করা। অন্যদিকে যখন কোন মুসলিম মারা যায় তখন তার জন্য আমাদের করণীয় কি তা জানা এবং মানার জন্য চেষ্টা করা আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য। আসুন আমরা আমাদের করণীয় সম্পর্কে অবগত হই--


১. নিজের ঋণ অথবা মা-বাবার কোনো ঋণ থাকলে তা দ্রুত পরিশোধ করা :

mrittur jonno koroniyo

রাসূলুল্লাহ সা. ঋণের পরিশোধ করার বিষয়ে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন । আবু হুরায়রা রা. হতে বর্ণিত হাদিসে রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন, 'মুমিন ব্যক্তির আত্মা তার ঋণের সাথে সম্পৃক্ত থেকে যায়; যতক্ষণ তা তার পক্ষ থেকে পরিশোধ করা হয় ।' (ইবনে মাজাহ্-২৪১৩)। আবু হুরায়রা রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন,

রাসূল সা.-এর নিকট যখন কোনো ঋণী ব্যক্তির জানাযা উপস্থিত করা হতো, তখন তিনি জিজ্ঞেস করতেন, 'সে তার ঋণ পরিশোধের জন্য অতিরিক্ত মাল রেখে গেছে কি?' যদি তাঁকে বলা হতো যে, সে তার ঋণ পরিশোধের মতো মাল রেখে গেছে। তখন তার জানাযার সালাত আদায় করতেন । নতুবা বলতেন, 'তোমাদের সাথির জানাযা আদায় করে নাও।

২. মা-বাবার অসিয়ত পূর্ণ করা- মা-বাবা শরিয়াহ সম্মত কোনো অসিয়ত করে গেলে তা পূর্ণ করা সন্তানদের উপর দায়িত্ব ।

৩. হজ বা উমরাহ করা- রাসূলুল্লাহ সা. বললেন, 'তুমি তোমার মায়ের পক্ষ থেকে হজ কর । তোমার কি ধারণা যদি তোমার মার উপর ঋণ থাকতো তবে কি তুমি তা পরিশোধ করতে না? সুতরাং আল্লাহর জন্য তা আদায় কর । কেননা আল্লাহর দাবি পরিশোধ করার অধিক উপযোগী ।' (বুখারি-১৮৫২)

৪. কুরবানি ও দান-সদকা করা :

মৃত মা-বাবার পক্ষ থেকে কুরবানি করলে তার সাওয়ার দ্বারা তারা উপকৃত হবে । রাসূলুল্লাহ সা. ছুরি হাতে নিয়ে দুম্বাটিকে শুইয়ে দিলেন। পশুটি জবেহ্ করার সময় বললেন, বিসমিল্লাহ, হে আল্লাহ তুমি এটি মুহাম্মাদ, তাঁর বংশধর এবং সকল উম্মাতে মুহাম্মাদির পক্ষ থেকে কবুল কর”। এভাবে তিনি তা দ্বারা কুরবানি করলেন। (মুসলিম-৫২০৩)

নিজের জন্য ও পিতা-মাতার জন্য দান সদকা করা । কারণ মৃত্যু হলেই সম্পদ অপরের মালিকানায় চলে যায়। বেঁচে থাকতেই সম্পদকে দানের মাধ্যমে নিজের সম্পদে পরিণত করতে হবে। হজরত আয়েশা রা. বলেন: “এক ব্যক্তি রাসূল সা.-এর কাছে এসে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমার মা হঠাৎ মৃত্যুবরণ করেছেন। তাই কোন অসিয়ত করতে পারেননি। আমার ধারণা তিনি যদি কথা বলার সুযোগ পেতেন তাহলে দান-সদকা করতেন। আমি তাঁর পক্ষ থেকে সদকা করলে তিনি কি এর সাওয়াব পাবেন? রাসূল সা. বললেন হ্যাঁ, অবশ্যই পাবেন ।” (মুসলিম-২৩৭৩)


৫. হজ-উমরাহ করা :

মৃত ব্যক্তির পক্ষ থেকে হজ করলে তা আদায় হবে এবং মৃত ব্যক্তি উপকৃত হবে। ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা হতে বর্ণিত হাদিসে এসেছে, ‘জুহাইনা গোত্রের একজন মহিলা রাসূলুল্লাহ সা.-এর কাছে আগমন করে বলল, হে আল্লাহর রাসূল, আমার মা হজ করার মানত করেছিলেন কিন্তু তিনি হজ সম্পাদন না করেই মারা গেছেন। এখন আমি কি তার পক্ষ থেকে হজ আদায় করতে পারি? রাসূলুল্লাহ সা. বললেন, 'তুমি তোমার মায়ের পক্ষ থেকে হজ কর । তোমার কি ধারণা যদি তোমার মার উপর ঋণ থাকতো তবে কি তুমি তা পরিশোধ করতে না? সুতরাং আল্লাহর জন্য তা আদায় কর। কেননা আল্লাহর দাবি পরিশোধ করার অধিক উপযোগী' (বুখারি-১৮৫২)

৬. রোজা রাখা- মৃত ব্যক্তির পক্ষ থেকে রোজা রাখা বৈধ হওয়ার দলিল হলো আয়েশা রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল সা. বলেছেন: “যে ব্যক্তি মৃত্যুবরণ করল এমতাবস্থায় যে তার উপর রোজা ওয়াজিব ছিল। তবে তার পক্ষ থেকে তার ওয়ারিশগণ রোজা রাখবে।” (বুখারি-১৯৫২)


৭. মা-বাবার বন্ধুদের সম্মান করা :

মা-বাবার বন্ধুদের সাথে ভালো ব্যবহার করা, সম্মান করা, তাদেরকে দেখতে যাওয়া, তাদেরকে হাদিয়া দেওয়া। এ বিষয়ে হাদিসে উল্লেখ আছে, আবদুল্লাহ ইবনে দীনার রা. আবদুল্লাহ ইবনে উমার রা. থেকে বর্ণনা করেন, একবার মক্কার পথে চলার সময় আবদুল্লাহ রা.-এর এক বেদুঈনের সাথে দেখা হলে তিনি তাকে সালাম দিলেন এবং তাকে সে গাধায় চড়ালেন যে গাধায় আবদুল্লাহ রাদিয়াল্লাহু আনহুমা উপবিষ্ট ছিলেন এবং তাঁর (আবদুল্লাহ) মাথায় যে পাগড়িটি পরা ছিলো তা তাকে প্রদান করলেন । আবদুল্লাহ রা. বললেন, তার পিতা, (আমার পিতা) উমার ইবনে খাত্তাব রা.-এর বন্ধু ছিলেন । আমি রাসূলুল্লাহ সা.কে বলতে শুনেছি “পুত্রের জন্য পিতার বন্ধু- বান্ধবের সাথে ভালো ব্যবহার করা সবচেয়ে বড় সওয়াবের কাজ।” (মুসলিম-৬৬৭৭)


৮. আত্মীয়দের সাথে সম্পর্ক রাখাসন্তান তার নিজের ও তার মা-বাবার আত্মীয়দের সাথে সম্পর্ক বজায় রাখবে । আবদুল্লাহ ইবনে উমার রা. থেকে বর্ণিত হাদিসে রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি তার পিতার সাথে কবরে সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করতে ভালোবাসে, সে যেন পিতার মৃত্যুর পর তার ভাইদের সাথে সু-সম্পর্ক রাখে।' (সহিহ ইবনে হিববান- ৪৩২)

৯. কাফফারা আদায় ও মান্নত পূরণ করা- সন্তান তার নিজের ও তার মা-বাবার শপথের কাফফারা ও ভুলকৃত হত্যাসহ কোন কাফফারা বাকি থাকলে সন্তান তা পূরণ করবে । সন্তান তার নিজের ও তার মা-বাবার কোনো মান্নত থাকলে সন্তান তা পূরণ করবে।

১০. মা-বাবার ভালো কাজসমূহ জারি রাখা :

সন্তান তার নিজের ও তার মা-বাবার যেসব ভালো কাজ অর্থাৎ মসজিদ তৈরি, মাদরাসা তৈরি, দীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তৈরিসহ যে কাজগুলো করেছেন সন্তান হিসাবে তা যাতে অব্যাহত থাকে তার ব্যবস্থা করা। হাদিসে এসেছে, 'ভালো কাজের পথপ্রদর্শনকারী এ কাজ সম্পাদনকারীর অনুরূপ সাওয়াব পাবে।'(তিরমিজি-২৬৭০) যে ব্যক্তি ইসলামের ভালো কাজ শুরু করল, সে এ কাজ সম্পাদনকারীর অনুরূপ সাওয়াব পাবে । অথচ তাদের সওয়াব থেকে কোনো কমতি হবে না ।" (মুসলিম-২৩৯৮)


১১. মাঝে মাঝে কবর জিয়ারত করা:

মৃত্যু ও আখিরাতের কথা স্মরণ করার নিয়তে কবর জিয়ারত করতে যাওয়া উচিত। হজরত আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত হয়েছে, নবী সা. তাঁর মায়ের কবর জিয়ারত করতে গিয়ে কাঁদলেন এবং তাঁর সাথে যে সাহাবিগণ ছিলেন তারাও কাঁদলেন। অতঃপর তিনি বললেন, “আমি আমার মায়ের মাগফিরাতের জন্য আল্লাহর কাছে আবেদন জানিয়েছিলাম কিন্তু আমাকে সে অনুমতি প্রদান করা হয়নি। তবে আমি মায়ের কবর জিয়ারতের জন্য আবেদন জানালে তিনি তা মঞ্জুর করেন। অতএব, তোমরা কবর জিয়ারত কর। কেননা কবর জিয়ারত করলে মৃত্যুর কথা স্মরণ হয়।” বুরাইদা রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, সাহাবীগণ করর জিয়ারত করতে গেলে নবী সা. তাদেরকে এই দুয়াটি পড়তে বলতেন- ‘আস-সালামু আলাইকুম আহলাদদিয়ারি মিনাল মুমিনিনা ওয়াল মুসলিমিনা ওয়া ইন্না ইনশাআল্লাহু লা লাহিকুনা আসআলুল্লাহু লানা ওয়া লাকুমুল আফিয়াতি। “কবর গৃহের হে মুমিন-মুসলিম অধিবাসীগণ, আপনাদের প্রতি শান্তি বর্ষিত হোক। আল্লাহ চাইলে আমরাও আপনাদের সাথে মিলিত হবো। আমি আমাদের জন্য এবং তোমাদের জন্য আল্লাহর নিকট নিরাপত্তা কামনা করছি।” (মুসলিম) 

১২. ওয়াদা বাস্তবায়ন করা- সন্তান তার নিজের ও তার মা- বাবার কোনো ভালো কাজের ওয়াদা করে থাকলে সন্তান যথাসম্ভব তা বাস্তবায়নের চেষ্টা করবে।
১৩. কোনো গুনাহের কাজ করে গেলে তা বন্ধ করা- সন্তান তার নিজের ও তার মা-বাবার গুনাহের কাজের সিদ্ধান্ত থাকলে তা বন্ধ করবে বা শরিয়ত সম্মতভাবে সংশোধন করে দিবে।

১৪. মাফ চাওয়া- অতীতে কারো সাথে খারাপ আচরণ করে থাকলে বা কারো উপর জুলুম করে থাকলে বা কাউকে কষ্ট দিয়ে থাকলে তার কাছ থেকে মাফ চেয়ে নিবে অথবা ক্ষতি পূরণ দিয়ে দিবে।


সদকায়ে জারিয়াহ রেখে যাওয়া- 

১. পানির ব্যবস্থা করা (বিশুদ্ধ পানির জন্য ফিল্টার দিতে পারেন)।
২. এতিমের/বিধবার প্রতিপালনের দায়িত্ব গ্রহণ করা।
৩. অসহায় মানুষের বাসস্থান/কর্ম সংস্থান তৈরি করা।
৪. গরিব তালিবে ইলমকে সাহায্য-সহযোগিতা করা। কুরআনের হাফেজ হতে সহায়তা করা।
৫. দাতব্য চিকিৎসালয় বা হাসপাতাল নির্মাণ, একটি হুইল চেয়ার বা বেড বা চেয়ার দান করা।
৬. মসজিদ নির্মাণ। মসজিদে জায়নামাজ, ফ্যান, কিতাব, পাঠাগার গঠন ইত্যাদি হাদিয়া হিসেবে দেওয়া।
৮. রক্ত দান করা/ চিকিৎসায় সহযোগিতা করা।
৯. ফলদায়ক গাছ লাগানো (রাস্তার পাশের পড়ে থাকা জমিতে ফলের বীজ ছিটিয়ে দেওয়া)।

লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য ও ইসলামী চিন্তাবিদ


পোস্ট ট্যাগ:
মৃতদের জন্য মাগফিরাতের আমল | মৃত্যুর ইচ্ছা পোষণ বা দোয়া করা নিষেধ | নিজের মৃত্যুর জন্য কি দোয়া করা যাবে? | বিপদে যেসব দোয়া করতে নিষেধ করেছেন বিশ্বনবি | মৃত্যু কামনার বৈধতা | মৃত ব্যক্তির জন্য দোয়া | কঠিন বিপদে মৃত্যু না চেয়ে যে দোয়া পড়বেন |  housing loan | better refinance rates | house mortgage loan | us bank refinance | housing finance companies | wells fargo refinance.

Post a Comment

Previous Post Next Post