আল্লাহর ভালোবাসা পেতে হলে | Allahor Valobasa pete hole

ড. মো: আকতার হোসেন

হজরত আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা:) বলেছেন, কিয়ামতের দিন আল্লাহ তায়ালা বলবেন, “হে আদম সন্তান! তুমি আমাকে দেখতে আসনি যখন আমি অসুস্থ ছিলাম ।” সে (মানুষ) বলবে, “আমি আপনাকে কিভাবে দেখতে আসতে পারি? আপনিতো সারা বিশ্বজগতের প্রতিপালক!!” তিনি বলবেন, “তুমি তো জেনে ছিলে যে, আমার অমুক বান্দা অসুস্থ ছিল, তবুও তুমি তাকে দেখতে যাওনি। তুমি কি জানতে না যে, যদি তুমি তাকে দেখতে যেতে, তবে তুমি তার নিকট আমাকে পেতে।” “হে বনী আদম (আদম সন্তান )! আমি খাদ্য চেয়েছিলাম তোমার কাছে , কিন্তু তুমি আমাকে দাওনি খাদ্য ।” সে তখন বলবে, হে আমার (রব) প্রতিপালক!

আপনিতো বিশ্বজাহানের প্রভু! আমি আপনাকে কিভাবে খাওয়াতে পারি? 

Allahor Valobasa

তিনি বলবেন, তুমিতো জেনে ছিলে যে, আমার অমুক বান্দা তোমার কাছে খাদ্য চেয়েছিল, কিন্তু তুমি তাকে খাদ্য দাওনি। তুমি কি জানতে না যে, তুমি যদি তাকে খাবার খাওয়াতে তাহলে আমার কাছ থেকে তা পেয়ে যেতে। (তিনি বলবেন) “হে আদম সন্তান! তোমার কাছে পানি চেয়েছিলাম, তুমি আমাকে তা দাওনি।” সে তখন বলবে, আপনি হলেন রব্বুল আলামীন (সমগ্র বিশ্বজগতের) প্রতিপালক,আপনাকে আমি কিভাবে পান করাতে পারি ? তিনি তখন বলবেন, “তুমি কি জানতে না যে, আমার (অমুক) বান্দা তোমার কাছে পানি চেয়েছিল, কিন্তু তুমি তাকে তা দাওনি। তুমি কি জানতে না যে, যদি তাকে তুমি পানি পান করাতে তবে তার পুরস্কার আমার নিকট পেতে।” (সহিহ মুসলিম)

রাবির পরিচয় :

রাসূল (সা:) এর জালিলুল কদর সাহাবী, সর্বাধিক হাদিস বর্ণনাকারী আবু হুরাইরা রা.। আবু হুরাইরা তাঁর উপনাম, প্রকৃত নাম আবদুল্লাহ অথবা আবদুর রহমান। (মতভেদ রয়েছে) তিনি ইয়েমেনের দাওসি গোত্রের লোক ছিলেন। ত্রিশ বছর বয়সে খায়বারে আগমন করে রাসূল (সা:) এর হাতে ইসলাম গ্রহণ করেন। ইসলাম গ্রহণের পরে তিনি যাবতীয় দুনিয়াবি ভোগবিলাস ত্যাগ করে আল্লাহর রাসূল (সা:) এর সাহচর্যে থেকে ইলম অর্জন করাকেই প্রাধান্য দেন। তিনি আহলে সুফফার একজন অন্যতম সদস্য ছিলেন। রাসূল (সা:) এর দোয়ার বরকতে তাঁর স্মরণশক্তি ছিল প্রখর। হাদিস বর্ণনার ক্ষেত্রে তিনি অধিক সতর্কতা অবলম্বন করতেন। তিনি নবী করীম (সা:) থেকে মোট ৫৩৭৪টি হাদিস বর্ণনা করেছেন। হজরত মুয়াবিয়া রা.-এর শাসনামলে তিনি দুইবার মদিনার গভর্নর নিযুক্ত হন। ৫৮-৫৯ হিজরিতে মদিনাতেই ইন্তেকাল করেন। এই সময় তাঁর বয়স ছিল প্রায় ৮০ বছর।

হাদিসের ব্যাখ্যা :

আলোচ্য হাদিসে ‘খিদমাতে খালক’ তথা সৃষ্টির সেবার প্রতি গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। হাদিসের মূল কথা হলো, আল্লাহর রহমত, বরকত ও সওয়াব হাসিলের সবচেয়ে সহজ এবং সংক্ষিপ্ত পথটি হচ্ছে, আল্লাহর সৃষ্টির প্রতি বিশেষত মানুষের প্রতি সহযোগিতা, কল্যাণ ও উপকারের হাত বাড়িয়ে দেয়া। পার্থিব জীবনে আমরা জিকির, সালাত, সাওম বা তাহাজ্জুদ ইত্যাদি ইবাদতের সওয়াব সম্পর্কে যতটুকু সচেতন, সৃষ্টির সেবার ফজিলত ও গুরুত্ব সম্পর্কে ঠিক ততটাই যেন বেখবর। আল্লাহকে ভালোবাসতে হলে অবশ্যই তাঁর সৃষ্টিকে ভালোবাসতে হবে এবং তাদের সেবা ও সাহায্যে এগিয়ে আসতে হবে। আল্লাহর রাসূল (সা:) অপর এক হাদিসে বলেন, “প্রত্যেক মুসলিমের দায়িত্ব মানুষের কল্যাণে ব্যয় করা।” -সহীহ আল বুখারি

মানবকল্যাণের গুরুত্ব সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সা. বলেন,

Human welfare

“যতক্ষণ পর্যন্ত একজন মানুষ অপর মানুষের কল্যাণে নিয়োজিত থাকবে ততক্ষণ পর্যন্ত আল্লাহ তা’আলা তার কল্যাণে রত থাকবেন। -সহিহ মুসলিম
অন্য এক হাদিসে রাসূলুল্লাহ সা. বলেন, 
“আল্লাহর নিকট সেই ব্যক্তিই সবচেয়ে প্রিয় যে মানুষের বেশি উপকার করে।” -আল মু’জামুল আওসাত
আলোচ্য হাদিসে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের কথা বলা হয়েছে। যথা :১. অসুস্থ ব্যক্তির খোঁজখবর নেওয়া ও তার সেবা করা ও ২. ক্ষুধার্ত ব্যক্তিকে খাদ্য দান করা ৩. পিপাসিত ব্যক্তিকে পানি পান করানো

আমরা পর্যায়ক্রমে উপরোল্লেখিত বিষয় তিনটির গুরুত্ব সম্পর্কে আলোচনা করার প্রয়াস পাবো

প্রথমত : অসুস্থ মানুষের প্রতি সমাজের অন্য মানুষের দায়িত্ব হলো, তাদের সেবা করা, দেখতে যাওয়া, চিকিৎসা গ্রহণে উৎসাহ প্রদান, মানসিক আস্থা তৈরি করা এবং দোয়া করা। হাদিসের ভাষ্যমতে, কাউকে অসুস্থ জানার পরও তাকে দেখতে না গেলে কিয়ামতের দিন আল্লাহর সামনে জবাবদিহি করতে হবে। রাসূল (সা:) বলেন, “যদি কেউ কোনো অসুস্থ ব্যক্তিকে দেখতে যায় তবে সে যেন ফিরে না আসা পর্যন্ত অবিরত জান্নাতের বাগানে ফল রোপণ করতে থাকে।” (সহিহ মুসলিম) অপর হাদিসে আছে, “যদি কেউ কোনো রোগীকে দেখতে যায় তখন সে (আল্লাহর) রহমতের মধ্যে সাঁতার কাটতে থাকে। আর যখন সে রোগীর পাশে বসে, তখন যেন সে রহমতের মাঝে ডুব দেয়।”

তিরমিজি শরিফে এসেছে, রাসূল (সা:) বলেন, যদি কোনো মুসলিম সকালে কোনো রোগীকে দেখতে যায় তাহলে সন্ধ্যা পর্যন্ত সারাদিন তার জন্য সত্তর হাজার ফেরেশতা দোয়া করতে থাকে। আর যদি সন্ধ্যায় দেখতে যায় তবে ৭০ হাজার ফেরেশতা ভোর পর্যন্ত তার (মাগফিরাত) ক্ষমার জন্য দোয়া করতে থাকে এবং তার জন্য জান্নাতে একটি সবুজ বাগান হবে। আবু হুরাইরা রা. বর্ণনা করেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, একজন মুসলমানের ওপর অপর মুসলমানের ছয়টি হক রয়েছে। প্রশ্ন করা হলো, হে আল্লাহর রাসূল! সেগুলো কী কী? তিনি সা. বললেন- ১.পরস্পরের দেখা হলে সালাম বিনিময় করা ২.কেউ দাওয়াত (আমন্ত্রণ) করলে গ্রহণ করা ৩.উপদেশ চাওয়া ব্যাক্তিকে (ভালো) উপদেশ দেয়া ৪.আর যদি কেউ হাঁচি দিয়ে (দোয়া পাঠ) আলহামদুলিল্লাহ বললে উত্তরে ইয়ারহামুক আল্লাহ বলা ৫.অসুস্থ হলে খোঁজখবর নেয়া এবং ৬.মৃত্যুবরণ করলে জানাজায় উপস্থিত থাকা। (মুসলিম-৪০২৩)

দ্বিতীয়ত : মানবসেবার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, ক্ষুধার্ত ব্যক্তিকে খাদ্য দান করা। আল্লাহর একজন অভাবী-অভুক্ত বান্দাকে ক্ষুধার্ত রেখে নিজে পেটপুরে খাবার গ্রহণ করলে কিয়ামতের দিন আল্লাহর কাছে জবাবদিহি করতে হবে। প্রকৃত মুমিন হতে হলে এবং আল্লাহর প্রিয় হতে চাইলে ক্ষুধার্ত ব্যক্তিকে খাওয়ানোর কোনো বিকল্প নেই। হাদিসে এসেছে, “যে ব্যক্তি তার প্রতিবেশীকে অভুক্ত রেখে তৃপ্তি সহকারে আহার করে সে মুমিন নয়।” (বাযযার, হাকিম ও তাহাবি) অন্যত্র আল্লাহর রাসূল (সা:) বলেন, আল্লাহর নিকট সেই ব্যক্তিই সবচেয়ে প্রিয় যে মানুষের বেশি উপকার করেআল্লাহর নিকট সবচেয়ে প্রিয় আমল হলো, কোনো মুসলিমের অন্তরে আনন্দ প্রবেশ করানো কিংবা তার বিপদ বা কষ্ট ইত্যাদি দূর করা, ঋণ আদায় করে দেয়া অথবা তার ক্ষুধা নিবারণ করা। (সহিহুত তারগিব)

আবু যার রা. বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
হে আবু যার! তুমি তরকারি রান্না করলে তাতে পানি (ঝোল) বেশি রাখো এবং তা তোমার প্রতিবেশীকে পৌঁছাও। (মুসলিম, আবু দাউদ, দারিমি ও হিব্বান)
হজরত আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল রা. ইরশাদ করেছেন, বিধবা এবং মিসকিনের সহযোগিতাকারী আল্লাহর রাস্তায় জিহাদকারীর ন্যায়, বা সর্বদা রাতে নামাজরত ও দিনের বেলা রোজাদার ব্যক্তির মত। (সহিহ বুখারি) যারা অভাবী ও মিসকিনকে খাবার দেয় না আল্লাহতায়ালা তাদের ব্যাপারে বলেন- ১) (হে রাসূল) আপনি কি সেই ব্যক্তিকে দেখেছেন যে আখেরাতের পুরস্কার ও শাস্তিকে মিথ্যা বলছে? ২) সে-ইতো এতিমকে ধাক্কা দেয় ৩) এবং মিসকিনকে খাবার দিতে উদ্বুদ্ধ করে না। (সূরা আল মাউন, আয়াত নং ১-৩ )


তৃতীয়ত : পিপাসার্ত ব্যক্তিকে পানি পান করানো 

আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের অন্যতম একটি মাধ্যম। এটি একটি সমাজসেবা বা মানবকল্যাণমুখী কর্ম। হাদিসের ভাষ্যমতে এটা একটি উত্তম সদকা হিসেবে। রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন, 
সর্বোত্তম দান (সদকা) হলো (তৃষ্ণার্ত ) মানুষকে পানি পান করানো।” -আহমদ, আবু দাউদ শরিফ
একদিন হযরত সাদ বিন উবাদা রা. এসে রাসূলুল্লাহ সা. কে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমার মা মৃত্যুবরণ করেছেন। তিনি তার (মাগফেরাতের) জন্য কোনো কিছুর ওসিয়ত করে যাননি। যদি আমি তার পক্ষ হয়ে কিছু সদকা করি, তবে কি তা আমার মাতার (মায়ের) কোনো উপকারে আসবে? নবীজি বললেন, হ্যাঁ, হবে। (তাহলে সদকা হিসেবে) তুমি মানুষকে পানি পান করাও। 

শুধুমাত্র মানুষই নয়, আল্লাহর সৃষ্টিকুলের যেকোনো প্রাণীকে (যার জীবন আছে) পানি পান করানোতেই ছাওয়াব (নেকী) নিহিত। হযরত আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলে আকরাম সা. বলেছেন, জনৈক লোক রাস্তা দিয়ে পথ চলতে চলতে তার ভীষণ তৃষ্ণা লাগলো। সে কূপ হতে পানি পান করল। তারপর সে বের দেখতে পেল যে, একটা কুকুর হাঁপাচ্ছে এবং তৃষ্ণার্ত হয়ে মাটি চাটছে। সে ভাবল, কুকুরটির আমার মতোই পিপাসা লেগেছে। তখন সে কূপের মধ্যে নামল এবং নিজের কাছে থাকা মোজা ভরে পানি নিয়ে এসে কুকুরটিকে পান করাল। আল্লাহ্পাক তার এই ভালো আমল কবুল করলেন এবং আল্লাহ তার গোনাহসমূহ মাফ করে দিলেন। সাহাবীগণ বললেন, ইয়া হাবিবাল্লাহ! চতুষ্পদ (৪ পা বিশিষ্ট) জন্তুর উপকার করলেও কি আমাদের সাওয়াব (নেকী) হবে? তিনি বললেন, প্রত্যেক জীবের উপকার করাতেই সাওয়াব (নেকী) রয়েছে।

উপরের তিনটি কর্মই মানবকল্যাণমুখী কর্ম। ইসলামের প্রচার ও প্রসারে এ ধরনের কাজগুলোর প্রতি গুরুত্বারোপ করতে হবে। খ্রিষ্টান মিশনারিগণ এই ধরনের সেবামূলক কাজ-কর্ম করার মাধ্যমে তাদের ধর্মের প্রসার ঘটাচ্ছে। মানবসেবার মাধ্যমে তারা মানুষদেরকে ধর্মান্তকরণ করছে। অতএব আমাদের দাওয়াতি কাজের সম্প্রসারণ ঘটাতে চাইলে এই জাতীয় কল্যাণমুখী কর্মের কোনোই বিকল্প নাই। আল্লাহর সুবহানাহু ওয়া তায়ালার কাছেও এর গুরুত্ব অপরিসীম। রাসূলুল্লাহ সা. বলেন, মানবকল্যাণমুখী কাজ বিপদ ও অপমৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করে। গোপনে করা দান আল্লাহর ক্রোধ নির্বাপিত করতে সহায়ক। রক্তসম্পর্কীয় আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করা আয়ু বৃদ্ধি করে থাকে। -হাইসামি

লেখক : ইসলামী চিন্তাবিদ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া। 

পোস্ট ট্যাগ:
আল্লাহর জন্য কাউকে ভালবাসা | মানুষের ভালোবাসা | আল্লাহ সবচেয়ে বেশি ভালোবাসেন | আল্লাহর ভালোবাসা লাভের দোয়া | আল্লাহ তাদের ভালোবাসেন | মানুষের প্রতি মানুষের ভালবাসা | যার দুঃখ বেশি তার প্রতি আল্লাহর ভালোবাসা বেশি |  housing loan | better refinance rates | house mortgage loan | us bank refinance | housing finance companies | wells fargo refinance.


Post a Comment

Previous Post Next Post