মহান আল্লাহর চিরন্তন মহিমা ও আমাদের দায়িত্বানুভূতি

মুহাদ্দিস ডক্টর এনামুল হক

Darsul-Quran


قُل لَّوْ كَانَ ٱلْبَحْرُ مِدَادًا لِّكَلِمَـٰتِ رَبِّى لَنَفِدَ ٱلْبَحْرُ قَبْلَ أَن تَنفَدَ كَلِمَـٰتُ رَبِّى وَلَوْ جِئْنَا بِمِثْلِهِۦ  مَدَدًا۰ قُلۡ اِنَّمَاۤ اَنَا بَشَرٌ مِّثۡلُکُمۡ یُوۡحٰۤی اِلَیَّ اَنَّمَاۤ اِلٰـهُکُمۡ اِلٰهٌ وَّاحِدٌ ۚ فَمَنۡ کَانَ یَرۡجُوۡا لِقَآءَ رَبِّهٖ فَلۡیَعۡمَلۡ عَمَلًا صَالِحًا وَّ لَا یُشۡرِکۡ بِعِبَادَۃِ رَبِّهٖۤ اَحَدًا ۰

অনুবাদঃ

১০৯. হে মুহাম্মাদ! লোকদের জানিয়ে দিন, যদি আমার রবের কথা লেখার জন্য সমুদ্র কালিতে পরিণত হয় তাহলে সেই সমুদ্র শুকিয়ে যাবে কিন্তু আমার রবের কথা শেষ হবে না। এমনকি যদি আমি তার মতো (আরো) সমুদ্র (লেখার কালি করে) সাহায্য করার জন্য নিয়ে আসি তাহলে তাও যথেষ্ট হবে না।

১১০. হে মুহাম্মাদ! বলুন, আমি তো একজন মানুষই তোমাদেরই মতো, আমার প্রতি ওহি করা হয় এ মর্মে যে, এক আল্লাহতোমাদের ইলাহ, কাজেই যে তার রবের সাক্ষাতের প্রত্যাশী তার সৎকাজ করা উচিত এবং বন্দেগির ক্ষেত্রে নিজের রবের সাথে কাউকে শরিক করা উচিত নয়। [সূরা কাহাফ : ১০৯-১০]

 

সূরা পরিচিতি :

সূরা কাহাফ আল কুরআনের ১৮ তম সূরা। এটি মক্কায় অবতীর্ণ, এর আয়াত সংখ্যা ১১০। আনাস ইবনে মালিক রা. হতে বর্ণিত, এ পূর্ণাঙ্গ সূরাটি একত্রে নাজিল হয়েছে এবং এর সঙ্গে ৭০ হাজার ফেরেশতা দুনিয়াতে আগমন করেছেন।

 

নামকরণ :

অত্র সূরার ৯ নং আয়াত-

اِذۡ اَوَی الۡفِتۡیَۃُ اِلَی الۡکَهۡفِ فَقَالُوۡا رَبَّنَاۤ اٰتِنَا مِنۡ لَّدُنۡکَ رَحۡمَۃً وَّ هَیِّیٴۡ لَنَا مِنۡ اَمۡرِنَا رَشَدًا ۰

এর  الۡکَهۡفِ শব্দ থেকে এ সূরার নামকরণ করা হয়েছে। এ নাম দেওয়ার অর্থ হচ্ছে এই যে, এটা এমন একটা সূরা যার মধ্যে আল-কাহাফ শব্দ এসেছে।

 

নাজিলের সময়কাল :

গবেষণা ও অনুসন্ধানে মাক্কি জীবনের প্রধান প্রধান ৪টি পর্যায় পাওয়া যায়- প্রথমত নবুয়্যত প্রাপ্তির পর থেকে তিন বছর গোপন দাওয়াতের পর্যায়। দ্বিতীয় : চতুর্থ বছর থেকে প্রকাশ্য দাওয়াত চরম জুলুম ও নির্যাতন এ পর্যায়ের মেয়াদকাল ছিল ২ বছর। তৃতীয় : পঞ্চম বছরের শেষের দিক থেকে ১০ বছর পর্যন্ত বিরোধিতা ও নির্যাতনের চরম পর্যায়। রাসূলের প্রিয়জনদের বিদায় (মৃত্যু), হাবশায় হিজরত ও শিয়াবে আবু তালিবে বন্দি জীবন। চতুর্থ : ১০ বছর থেকে ১৩ তম বছর পর্যন্ত ৩ বছর সবচেয়ে কঠিন ও বিপজ্জনক সময়। রাসূল সা. কে হত্যা, বন্দী ও নগর থেকে বিতাড়িত করার চূড়ান্ত ষড়যন্ত্র।

    সূরা কাহাফের বিষয়বস্তু নিয়ে চিন্তা করলে বুঝা যায়, মাক্কি যুগের তৃতীয় অধ্যায় (৫ম নববী সন থেকে ১০ম নববী সন পর্যন্ত)-এর শুরুতেই এ সূরাটি নাজিল হয়ে থাকবে। এ সময় জুলুম, নির্যাতন, বিরোধীতা চরম পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল ঠিকই কিন্তু তখনো মুসলমানরা হাবশায় হিজরত করেনি। তখন যেসব মুসলমান নির্যাতিত হচ্ছিল তাদেরকে আসহাবে কাহাফের কাহিনী শুনানো হয়, যাতে তাদের সাহস ও হিম্মত বেড়ে যায় এবং তারা জানতে পারে যে, ঈমানদাররা নিজেদের ঈমান বাঁচানোর জন্য ইতঃপূর্বে কেমন পথ ও পদ্ধতি অবলম্বন করেছেন।

 

বিষয়বস্তু ও মূল বক্তব্য :

মকাকার মুশরিকরা মহানবী সা.-এর পরীক্ষা নেওয়ার জন্য আহলি কিতাবদের পরামর্শক্রমে তাঁর সামনে যে তিনটি প্রশ্ন করেছিল তার জবাবে এ সূরাটি নাজিল হয়। প্রশ্ন তিনটি ছিল: এক, আসহাবে কাহাফ কারা ছিলেন? দুই, খিজিরের ঘটনা এবং তার তাৎপর্য কি? তিন, জুলকারনাইনের ঘটনাটি কী? এ তিনটি কাহিনীই খ্রিস্টান ও ইহুদিদের ইতিহাসের সাথে সম্পর্কিত ছিল। হিজায এলাকায় এর কোনো চর্চা ছিল না। তাই আহলি কিতাবরা মুহাম্মাদ সা.-এর কাছে সত্যিই কোনো গায়েবি ইলমের মাধ্যম আছে কিনা তা জানার জন্যই এগুলো নির্বাচন করেছিল।

 কিন্তু আল্লাহ তায়ালা তাঁর প্রিয় নবীর মুখ দিয়ে কেবল এগুলোর পূর্ণ জবাব দিয়েই ক্ষান্ত হননি বরং এ সঙ্গে এ ঘটনা তিনটিকে সে সময় মক্কায় কুফর ও ইসলামের মধ্যে যে অবস্থা বিরাজ করছিল তার সাথে পুরোপুরি খাপ খাইয়ে দিয়েছেন। কাফিরদের পরীক্ষামূলক প্রশ্নগুলো তাদের ওপরই পুরোপুরি উল্টে দেওয়ার পর বক্তব্যের শেষে আবার সেই একই কথার পুনরাবৃত্তি করা হয়েছে, বক্তর্ব শুরু করার সময় যা বলা হয়েছিল। অর্থাৎ তাওহিদ ও আখিরাত হচ্ছে পুরোপুরি সত্য। এক মেনে নেওয়া, সে অনুযায়ী নিজেদের পুরোপুরি সংশোধন করা এবং আল্লাহ তায়ালার সামনে নিজেদের জবাবদিহি করতে হবে বলে মনে করে দুনিয়ায় জীবন যাপন করার মধ্যেই তোমাদের নিজেদের কল্যাণ ও সফলতা রয়েছে। নতুবা তোমাদের নিজেদের জীবন অনিবার্যভাবে ধ্বংস হবে এবং তোমাদের সব কার্যকলাপও নিষ্ফল ও ব্যর্থ হয়ে যাবে।

 

সূরা আল কাহাফের ফজিলত :

Sura Al Kahaf

সহিহ সনদে বর্ণিত হয়েছে,

“আবু দারদা রা. হতে বর্ণিত, মহানবী সা. বলেন, যে ব্যক্তি সূরা কাহাফের প্রথম দশটি আয়াত মুখস্থ করে সে দাজ্জালের ফিতনা হতে নিরাপদ থাকবে। তাঁর থেকে আরেকটি রিওয়ায়াতে শেষ ১০ আয়াতের ব্যাপারে উল্লিখিত ফজিলতের বর্ণনা রয়েছে।” [সহিহ মুসলিম-১৩৪২; সুনানু আবি দাউদ-৩৭৬৫; তিরমিজি-২৮১১]

সুতরাং প্রথম বা শেষ ১০ আয়াত যে মুখস্থ করবে সে এবং ২০ আয়াতই মুখস্থ করবে সেও উল্লিখিত ফজিলতের অন্তর্ভূক্ত হবে।

এ ছাড়াও জুমার দিনে এ সূরা তিলাওয়াতের রয়েছে বিশেষ ফজিলত। হাদিসে এসেছে,

আবু সাঈদ খুদরী রা. রাসুলূল্লাহ সা. থেকে বর্ণনা করেন, যে ব্যাক্তি জুমার দিন সূরা কাহাফ পাঠ করবে তার জন্য এক জুম’আ থেকে অপর জুম’অ পর্যন্ত আলোকিত হয়ে থাকে।” [আল মুসতাদরাক-৩৩৪৯; মিশকাতুল মাসাবীহ-২১৭৫। সনদ : হাসান]

 

১০৯ নং আয়াতের ব্যাখ্যা

আল্লাহ তায়ালা বলেন,

قُل لَّوْ كَانَ ٱلْبَحْرُ مِدَادًا لِّكَلِمَـٰتِ رَبِّى لَنَفِدَ ٱلْبَحْرُ قَبْلَ أَن تَنفَدَ كَلِمَـٰتُ رَبِّى وَلَوْ جِئْنَا بِمِثْلِهِۦ مَدَدًا۰

“হে মুহাম্মাদ! লোকদের জানিয়ে দিন, যদি আমার রবের কথা লেখার জন্য সমুদ্র কালিতে পরিণত হয় তাহলে সেই সমুদ্র শুকিয়ে যাবে কিন্তু আমার রবের কথা শেষ হবে না। এমনকি যদি আমি তার মতো (আরো) সমুদ্র (লেখার কালি করে) সাহায্য করার জন্য নিয়ে আসি তাহলে তাও যথেষ্ট হবে না।” এখানে রবের কথা বলতে তাঁর হিকমাত ও নিদর্শনসমূহ বোঝানো হয়েছে।

 “আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রা. বলেন, ইয়াহুদিরা বলেন, হে মুহাম্মদ! আপনি তো মনে করেন আমাদেরকে হিকমাহ দেওয়া হয়েছে। আর আপনার কিতাবে উল্লেখ করা হয়েছে, যাকে হিকমাহ দান করা হয়েছে তাকে প্রভূত কল্যাণ দান করা হয়েছে। অতঃপর আপনার কিতাবে বলা হয়েছে, আপনাদেরকে যে ইলম দেওয়া হয়েছে, তা অতি নগণ্য। অতঃপর আল্লাহ তায়ালা উক্ত আয়াত নাজিল করেন।” [তাফুসিরুল কুরতুবি, ১১ খন্ড, পৃ: ৬৮; তাফসিরুল বাহরুল মুহিত, ষষ্ঠ খন্ড, পৃ: ১৬৮]

 রবী ইবন আনাস রা. বলেন, “সকল মানুষের জ্ঞান আল্লাহ তায়ালার জ্ঞানের তুলনায় সম্মিলিত সমুদ্রসমূহের এক ফোঁটা পানির সমতুল্য।” [ইবনে কাছির, ৫ম খন্ড পৃ:২০৪]

 এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা অন্যত্র বলেন,

পৃথিবীতে যত গাছ আছে তা সবই যদি কলম হয়ে যায় এবং সমুদ্র (দোয়াত হয়ে যায়), তাকে আরো সাতটি সমুদ্র কালি সরবরাহ করে তবুও আল্লাহর কথা (লেখা) শেষ হবে না। অবশ্যই আল্লাহ মহাপরাক্রমশালী ও প্রজ্ঞাময়।” [সূরা লোকমান : ২৭]

আল্লাহর কথা’ অর্থ তার সৃষ্টিকর্ম এবং তার শক্তি ও জ্ঞানের নিদর্শন। বিষয়বস্তুটি এ আয়াতে একটু ভিন্ন ভাষায় বর্ণনা করা হয়েছে। আপাতদৃষ্টে কোনো ব্যাক্তি ধারণা করতে পারে, বোধ হয় এ বক্তব্যে বাড়াবাড়ি বা অতিকথন আছে। কিন্তু সামান্য চিন্তা করলে অনুভব করবে, এর মধ্যে তিল পরিমাণও অতিকথন নেই। এ পৃথিবীর গাছগুলো কেটে যতগুলো কলম তৈরি করা যেতে পারে এবং পৃথিবীর বর্তমান সাগরের পানির সাথে আরো তেমনি সাতটি সাগরের পানিকে কালিতে পরিণত করলে তা দিয়ে আল্লাহর শক্তি, জ্ঞান ও সৃষ্টির কথা লিখে শেষ করা তো দূরের কথা হয়তো, পৃথিবীতে যেসব জিনিস আছে সেগুলোর তালিকা তৈরি করাই সম্ভবপর হবে না। শুধুমাত্র এ পৃথিবীতেই যেসব জিনিসের অস্তিত্ব রয়েছে সেগুলোই গণনা করা কঠিন, তার ওপর আবার এই অথৈ মহাবিশ্বের সৃষ্টির বিবরণ লেখার তো কোনো প্রশ্নই ওঠে না।

 এ বর্ণনা থেকে আসলে এ ধরণের একটি ধারণা দেওয়াই উদ্দেশ্য যে, এত বড়ো বিশ্বজাহানকে যে আল্লাহ তায়ালা অস্তিত্ব দান করেছেন এবং আদি থেকে অনন্তকাল পর্যন্ত এর যাবতীয় আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থা পরিচালনা করে চলেছেন তাঁর সার্বভৌম কর্তৃত্বের ক্ষেত্রে তোমরা যেসব ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সত্তাকে উপাস্যে পরিণত করে রেখেছো তাদের গুরুত্ব ও মর্যাদাই বা কী! এই বিরাট-বিশাল সম্রাজ্য পরিচালনায়  হস্তক্ষেপ করা তো দূরের কথা, এর ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অংশ সম্পর্কে পূর্ণ জ্ঞান এবং নিছক জ্ঞানটুকু পর্যন্ত লাভ করার ক্ষমতা কোনো সৃষ্টির নেই। তাহলে কেমন করে এ ধারণা করা যেতে পারে যে, সৃষ্টিকুলের মধ্য থেকে কেউ এখানে আল্লাহর সার্বভৌম কর্তৃত্ব ও ক্ষমতার কোনো অংশও লাভ করতে পারে, যার ভিত্তিতে সে ভাগ্য ভাঙ্গা-গড়ার ক্ষমতার অধিকারী হয়ে বসে? [তাফহীমুল কুরআন, ১১ খন্ড, পৃ: ১০২-৩]

 

১১০ নং আয়াতের ব্যাখ্যা :

আল্লাহ তায়ালার বাণী,

قُلۡ اِنَّمَاۤ اَنَا بَشَرٌ مِّثۡلُکُمۡ یُوۡحٰۤی اِلَیَّ اَنَّمَاۤ اِلٰـهُکُمۡ اِلٰهٌ وَّاحِدٌ ۚ فَمَنۡ کَانَ یَرۡجُوۡا لِقَآءَ رَبِّهٖ فَلۡیَعۡمَلۡ عَمَلًا صَالِحًا وَّ لَا یُشۡرِکۡ بِعِبَادَۃِ رَبِّهٖۤ اَحَدًا ۰

“হে মুহাম্মাদ! বলুন, আমি তো একজন মানুষই তোমাদেরই মতো, আমার প্রতি ওহি করা হয় এ মর্মে যে, এক আল্লাহ তোমাদের ইলাহ, কাজেই যে তার রবের সাক্ষাতের প্রত্যাশী তার সৎকাজ করা উচিত এবং বন্দেগির ক্ষেত্রে নিজের রবের সাথে কাউকে শরিক করা উচিত নয়।” [সূরা কাহাফ : ১০৯-১০]

     এর অর্থ সম্পর্কে ইবন জারির আত তাবারী (রহ) উল্লেখ করেন, “হে মুহাম্মাদ! (বলুন) আমি তো তোমাদের মতোই মানুষ, আদম (আ)-এর সন্তান, আমার কোনো ইলম নেই, শুধুমাত্র যা আল্লাহ আমাকে শিক্ষা দিয়েছেন, তাই আমার আয়ত্তে। এবং নিশ্চয়ই আল্লাহ তায়ালা আমার নিকট ওহি পাঠান যে, তোমাদের ইবাদতের যোগ্য ইলাহ তিনিই এবং তোমাদের ওপর অপরিহার্য যে, তোমরা তাঁরই ইবাদ করবে এবং তাঁর সাথে কাউকে শরিক করবে না। ইবাদতের যোগ্য ইলাহ একমাত্র তিনিই, দ্বিতীয় কেউ নন এবং তাঁর কোনো অংশীদার নেই। [জামিঈল বায়ান ফি তা’বিলিল কুরআন, ইবন জারির আত তাবারী, ১৮ খন্ড, পৃ: ১২৫]


 قُلۡ اِنَّمَاۤ اَنَا بَشَرٌ مِّثۡلُکُمۡ یُوۡحٰۤی اِلَیَّ- এর ব্যাখ্যা :

হে মুহাম্মাদ! বলুন, আমি তো একজন মানুষ তোমাদেরই মতো, আমার প্রতি ওহি করা হয়- এখানে আরবি শব্দ بَشَرٌ (বাশার) দ্বারা শুধুমাত্র মানুষ বুঝানো হয়েছে। অন্যত্র আল্লাহ তায়ালা বলেন,

قُلۡ اِنَّمَاۤ اَنَا بَشَرٌ مِّثۡلُکُمۡ یُوۡحٰۤی اِلَیَّ اَنَّمَاۤ اِلٰـهُکُمۡ اِلٰهٌ وَّاحِدٌ فَاسۡتَقِیۡمُوۡۤا اِلَیۡهِ وَ اسۡتَغۡفِرُوۡهُ ؕ وَ وَیۡلٌ لِّلۡمُشۡرِکِیۡنَ۰

“হে নবী, এদের বলে দাও আমি তো তোমাদের মতোই একজন মানুষ। আমাকে ওহির মাধ্যমে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে যে, একজনই মাত্র তোমাদের ইলাহ কাজেই সোজা তাঁর প্রতি নিবিষ্ট হও এবং তাঁর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করো। মুশরিকদের জন্য ধ্বংস।” [সূরা হামিম আস-সাজদা : ৬]

وَ اِذۡ قَالَ رَبُّکَ لِلۡمَلٰٓئِکَۃِ اِنِّیۡ خَالِقٌۢ بَشَرًا مِّنۡ صَلۡصَالٍ مِّنۡ حَمَاٍ مَّسۡنُوۡنٍ۰

“তারপর তখনকার কথা স্বরণ করো যখন তোমার রব ফেরেশতাদের বললেন, আমি শুকনো ঠনঠনে পচা মাটি থেকে একটি মানুষ সৃষ্টি করছি।” [সূরা হিজর : ২৮]

وَ هُوَ الَّذِیۡ خَلَقَ مِنَ الۡمَآءِ بَشَرًا فَجَعَلَهٗ نَسَبًا وَّ صِهۡرًا ؕ وَ کَانَ رَبُّکَ قَدِیۡرًا۰

“আর তিনিই (আল্লাহ তায়ালা) পানি থেকে একটি মানুষ তৈরি করেছেন, আবার তার থেকে বংশীয় ও শ্বশুরালয়ের দু’টি আলাদা ধারা চালিয়েছেন। তোমার রব বড়োই শক্তিসম্পন্ন।” [সূরা ফুরকান : ৫৪]

اِذۡ قَالَ رَبُّکَ لِلۡمَلٰٓئِکَۃِ اِنِّیۡ خَالِقٌۢ بَشَرًا مِّنۡ طِیۡنٍ۰

“যখন তোমার রব ফেরেশতাদেরকে বললেন, আমি মাটি দিয়ে একটি মানুষ তৈরি করবো।” [সূরা সাদ : ৭১]

আবার অন্যত্র بَشَرً (বাশার) দ্বারা ফেরেশতাদেরও বুঝানো হয়েছে।


اَنَّمَاۤ اِلٰـهُکُمۡ اِلٰهٌ وَّاحِدٌ-এর ব্যাখ্যা :

নিশ্চয়ই তোমাদের ইলাহ এক। তাওহিদের দ্ব্যার্থহীন এ ঘোষণা ঈমানের অপরিহার্য ও অনিবার্য বিষয়। কুরআনুল কারিমের পাতায় পাতায় এ ডিক্লারেশন ঘোষিত হয়েছে। আল্লাহর বাণী;

 شَهِدَ اللّٰهُ اَنَّهٗ لَاۤ اِلٰهَ اِلَّا هُوَ ۙ وَ الۡمَلٰٓئِکَۃُ وَ اُولُوا الۡعِلۡمِ قَآئِمًۢا بِالۡقِسۡطِ ؕ لَاۤ اِلٰهَ اِلَّا هُوَ الۡعَزِیۡزُ الۡحَکِیۡمُ۰

আল্লাহ নিজেই সাক্ষ্য দিয়েছেন, তিনি ছাড়া আর কোনো ইলাহ নেই। আর ফেরেশতা ও সকল জ্ঞানবান লোকাই সততা ও ন্যায়পরায়ণতার সাথে এ সাক্ষ্য দিচ্ছে যে, সেই প্রবল পরাক্রান্ত ও জ্ঞানবান সত্তা ছাড়া আর কোনো ইলাহ নেই।” [সূরা আলে ইমরান : ১৮]

اِنَّ اِلٰـهَکُمۡ لَوَاحِدٌ۰

“তোমাদের প্রকৃত ইলাহ মাত্র একজনই।” [সূরা সাফফাত : ৪]

 

“হে লোকেরা! এক আল্লাহই তোমাদের ইলাহ, যিনি ছাড়া আর কোনো ইলাহ নেই, প্রত্যেক জিনিসের ওপর তাঁর জ্ঞান পরিব্যাপ্ত।” [সূরা ত্বহা : ৮৮]

 وَ اِلٰـهُکُمۡ اِلٰهٌ وَّاحِدٌ ۚ لَاۤ اِلٰهَ اِلَّا هُوَ الرَّحۡمٰنُ الرَّحِیۡمُ۰

“তোমাদের আল্লাহ এক ও একক। সেই দয়াবান ও করুণাময় আল্লাহ ছাড়া আর কোনো ইলাহ নেই।” [সূরা বাকারা : ১৬৩]

 

فَمَنۡ کَانَ یَرۡجُوۡا لِقَآءَ رَبِّهٖ فَلۡیَعۡمَلۡ عَمَلًا صَالِحًا-এর ব্যাখ্যা :

যে তার রবের সাক্ষাতের প্রত্যাশী তার উচিত সৎকাজ করা-এর অর্থ হচ্ছে, যে ব্যক্তি তার মালিকের সাথে সাক্ষাৎ ও তাঁর পক্ষ থেকে সৎকমেংর বিনিময় লাভের প্রত্যাশা করে, সে যেন আল্লাহর প্রেরিত শরিয়াহসম্মত নেক আমল করে। আল্লাহ তায়ালা বলেন,

 مَنۡ کَانَ یَرۡجُوۡا لِقَآءَ اللّٰهِ فَاِنَّ اَجَلَ اللّٰهِ لَاٰتٍ ؕ وَ هُوَ السَّمِیۡعُ الۡعَلِیۡمُ۰

“যে কেউ আল্লাহর সাথে সাক্ষাৎ করার আশা করে (তার জানা উচিত), আল্লাহর নির্ধারিত সময় আসবেই। আর আল্লাহ সবকিছু শোনেন ও জানেন।” [সূরা আনকাবুত : ৫]

 اَمَّنۡ هُوَ قَانِتٌ اٰنَآءَ الَّیۡلِ سَاجِدًا وَّ قَآئِمًا یَّحۡذَرُ الۡاٰخِرَۃَ وَ یَرۡجُوۡا رَحۡمَۃَ رَبِّهٖ ؕ قُلۡ هَلۡ یَسۡتَوِی الَّذِیۡنَ یَعۡلَمُوۡنَ وَ الَّذِیۡنَ لَا یَعۡلَمُوۡنَ ؕ اِنَّمَا یَتَذَکَّرُ اُولُوا الۡاَلۡبَابِ۰

“(এ ব্যক্তির আচরণই সুন্দর না সে ব্যক্তির আচরণ সুন্দর) যে আনুগত, রাতের বেলা দাঁড়ায় ও সিজদা করে আখেরাতকে ভয় করে এবং নিজের রবের রহমতের আশা করে? এদের জিজ্ঞেস করো যারা জানে এবং যারা জানে না তারা কি পরস্পর সমান হতে পারে? কেবল বিবেক-বুদ্ধির অধিকারীরাই উপদেশ গ্রহণ করে।” [সূরা যুমার : ৯]

 

وَّ لَا یُشۡرِکۡ بِعِبَادَۃِ رَبِّهٖۤ اَحَدًا-এর ব্যাখ্যা :

ইবাদতের ক্ষেত্রে নিজের রবের সাথে কাউকে শরিক করে না। শিরক সবচেয়ে বড় কবিরা গুনাহ। আল্লাহ তায়ালা বলেন,

 وَ اِذۡ قَالَ لُقۡمٰنُ لِابۡنِهٖ وَ هُوَ یَعِظُهٗ یٰبُنَیَّ لَا تُشۡرِکۡ بِاللّٰهِ ؕؔ اِنَّ الشِّرۡکَ لَظُلۡمٌ عَظِیۡمٌ۰

“স্বরণ করো যখন লুকমান নিজের ছেলেকে উপদেশ দিচ্ছিল, সে বললো, হে পুত্র! আল্লাহর সাথে কাউকে শরিক করো না। যথার্থই শিরক অনেক বড় জুলুম।” [সূরা লোকমান : ১৩]

অন্য অপরাধ আল্লাহ তায়ালা মাফ করলেও শিরকের অপরাধ মাফ করবেন না। আল্লাহর বাণী;

 اِنَّ اللّٰهَ لَا یَغۡفِرُ اَنۡ یُّشۡرَکَ بِهٖ وَ یَغۡفِرُ مَا دُوۡنَ ذٰلِکَ لِمَنۡ یَّشَآءُ ۚ وَ مَنۡ یُّشۡرِکۡ بِاللّٰهِ فَقَدِ افۡتَرٰۤی اِثۡمًا عَظِیۡمًا۰

“নিশ্চয়ই আল্লাহ শিরককে মাফ করেন না। এ ছাড়া অন্যান্য যত গোনাহ হোক না কেন তিনি যাকে ইচ্ছা মাফ করে দেন। যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে আর কাউকে শরিক করেছে সেতো এক বিরাট মিথ্যা রচনা করেছে এবং কঠিন গোনাহের কাজ করেছে।” [সূরা নিসা : ৪৮]

“যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে কাউকে শরিক করেছে তার ওপর আল্লাহ জান্নাত হারাম করে দিয়েছেন এবং তার আবাস জাহান্নাম। আর এ ধরনের জালেমদের কোনো সাহায্যকারী নেই।” [সূরা মায়িদা : ৭২]

হাদিসে এসেছে,

“আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রা. হতে বর্ণিত, তিনি বললেন, একবার এক ব্যক্তি রাসূলূল্লাহ সা.-এর খেদমতে এসে বললো, হে আল্লাহর রাসূল সা.! আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে আমি অনেক আমল করে থাকি, কিন্তু অন্য লোক আমার এ নেক আমলসমূহ দেখুক তা আমার ভালো লাগে। ব্যাপারে শরিয়তের বিধান কি? তিনি তাঁর প্রশ্নের উত্তর দিলেন না। অবশেষে নাজিল হলো:-

 فَمَنۡ کَانَ یَرۡجُوۡا لِقَآءَ رَبِّهٖ فَلۡیَعۡمَلۡ عَمَلًا صَالِحًا وَّ لَا یُشۡرِکۡ بِعِبَادَۃِ رَبِّهٖۤ اَحَدً۰

[আল মুসতাদরাক আলাস সহিহাইন-২৫২৭, ৭৯৩৯; বায়হাকি-৬৮৫৪। সনদ: হাসান]

অন্য হাদিসে এসেছে,

“মাহমুদ ইবন লাবিদ রা. হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সা. বলেন, নিশ্চয়ই আমি তোমাদের ব্যাপারে অধিক ভয় করি শিরকে আসগারের ব্যাপারে। আর সেটি হলো রিয়া বা লৌকিকতা।” [মুসনাদু আহমাদ-২২৫২৩ ও ৭; মিশকাতুল মাসাবিহ-৫৩৩৪। সনদ: সহিহ]


শিক্ষা :

১. আল্লাহর কালামের তাৎপর্য ও মর্মার্থ অসীম। এর তাফসির ও বয়ান লিখে বর্ণনা করে শেষ করা যাবে না।
২. রাসূলুল্লাহ সা. আমাদের মতোই মানুষ। পার্থক্য তাঁর নিকট ওহি নাজিল হয় এবং সে মোতাবেক পথনির্দেশনা প্রদান করেন।
৩. আল্লাহ তায়ালা এক ও একক। তাওহিদের এ ঈমান ও আকিদা জীবনের সর্বক্ষেত্রে পোক্তভাবে মেনে চলতে হবে।
৪. আল্লাহর রোজামন্দির হাসিলের লক্ষ্যে সর্বাবস্থায় আল্লাহরেই নির্দেশিত আমলে সালিহ করতে হবে।
৫. আকিদা, বিশ্বাস, কাজ ও চিন্তা-চেতনাসহ যাবতীয় শিরক হতে বিরত থাকতে হবে। তাতেই আল্লাহর দিদার লাভ হবে।

আল্লাহ তায়ালা আমাদের তাওফিক দান করুন।

লেখক : প্রধান মুহাদ্দিস (সহকারী অধ্যাপক)
বিজুল দারুল হুদা কামিল মাদরাসা, বিরামপুর, দিনাজপুর

পোস্ট ট্যাগ:
ইসলামে জবাবদিহিতা, আদর্শ মানব হযরত মুহাম্মদ (সা.), মাওলানা মওদুদী (র), ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে কাঙ্ক্ষিত শিক্ষানীতি,দায়িত্ব ও ক্ষমতা চেয়ে নিতে নেই, দায়িত্বশীলের গুণাবলী আয়াত, জবাবদিহিতা কী, দায়িত্বশীলদের দায়িত্ব ও কর্তব্য, কুল্লুকুম রাইন।

Post a Comment

Previous Post Next Post