নিজামুল মুলক তুসি রাহ.
ইমাম জাহাবি রাহ. লেখেন, ‘প্রধান উজির নিজামুল মুলক কিওয়ামুদ্দিন আবু আলি হাসান ইবনু আলি ইবনু ইসহাক তুমি ছিলেন তীক্ষ্ণবুদ্ধি-সম্পন্ন, বোদ্ধা, সজাগমস্তিষ্ক, দীনদার, পুণ্যবান এবং গম্ভীর ও দূরদর্শী ব্যক্তি। সবসময় তাঁর দরবারে থাকত আলিম ও ফকিহগণের ভিড়। তিনি ছিলেন জ্ঞানের প্রতি অনুরাগী ব্যক্তি। বাগদাদ, নিশাপুর এবং তুস শহরে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন যুগশ্রেষ্ঠ তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়। তিনিই ছাত্রদের জন্য ভাতাব্যবস্থা প্রবর্তনের সূচনা করেন। তাঁর ইশারায় হাদিস সংকলনের কাজ শুরু হলে তাঁর খ্যাতি রাষ্ট্রের গণ্ডি ছাড়িয়ে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে।'
তিনি সুলতান আলপ আরসালান এবং তাঁর ছেলে সুলতান মালিক শাহ উভয়ের শাসনকালব্যাপী প্রধানমন্ত্রিত্বের আসনে অধিষ্ঠিত ছিলেন; রাষ্ট্রব্যবস্থা স্থিতিশীল করতে এবং দেশ থেকে অনাচার ও অরাজকতা দূর করতে অবিস্মরণীয় ভূমিকা রাখেন। জনসাধারণের সঙ্গে তাঁর নম্র ব্যবহার ছিল প্রবাদতুল্য। তাদের সুবিধার জন্য দেশব্যাপী সরাইখানা প্রতিষ্ঠা করেন। দেশের যেকোনো প্রান্তে শাস্ত্রীয় অভিজ্ঞ ব্যক্তির খোঁজ পেলে তাকে বাগদাদে নিজের কাছে ডেকে আনতেন।
একজন দক্ষ প্রশাসক
নিজামুল মুলকের ইশারায়ই সুলতান মালিক শাহ তাঁর প্রশাসন এবং সামরিক বিভাগে বসাতে পেরেছিলেন সময়ের যোগ্যতম ব্যক্তিদের। এদের কর্মতৎপরতাই প্রমাণ করেছিল নিজামুল মুলকের দূরদর্শী চিন্তাধারা এবং মানুষ চেনার যোগ্যতা।
তুসির পরামর্শে প্রশাসনে যাদের বসানো হয়েছিল তাদের অন্যতম ছিলেন আক সুনকুর। এ মহান লোকটিই ছিলেন ইসলামি ইতিহাসের মহান দুই সত্তা – ইমাদুদ্দিন মাহমুদ জিনকির পিতা এবং নুরুদ্দিন জিনকির দাদা। আল্লামা ইবনু কাসির রাহ. তাঁর সম্পর্কে লেখেন, ‘তিনি চরিত্রে, কৃতিত্বে, মহত্ত্বে এবং বদান্যতায় ছিলেন সকল গভর্নরদের শীর্ষে।
তাঁর ছেলে ইমাদুদ্দিন জিনকিই শুরু করেছিলেন ক্রুসেডারদের বিরুদ্ধে জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহর ধারা, যা এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন তাঁর ছেলে নুরুদ্দিন জিনকি রাহ.। এই পরিবারের সদস্যরাই পরবর্তীতে সুলতান সালাহুদ্দিন আইয়ুবি, রুকনুদ্দিন বাইবার্স ও কালাউনের মাধ্যমে ক্রুসেডবিরোধী বিজয়ে অবদান রেখেছিল। ভূমিকা রেখেছিল বিশ্বমুসলিমকে ঐক্যবদ্ধ ও দুর্জয় হিসেবে আত্মপ্রকাশে।
আক সুনকুর ছিলেন সুলতান মাহমুদ সেলজুকির নেতৃত্বের অন্যতম নেতা। আক ছিলেন মসুলের গভর্নর। ক্রুসেডারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধসূচনাকারী। এ মহান পুরুষ মসুলের জামে মসজিদে সালাত আদায়কালে আততায়ীর হাতে ৫২০ হিজরিতে শাহাদাত বরণ করেন।
ইতিহাসবিদ ইবনু আসির লেখেন, ‘তিনি ছিলেন এক তুর্ক দাস। উন্নত গুণাবলি, বীরত্ব আর দীনি জজবার দরুন তৎকালীন আলিমগণ ও পুণ্যবানদের চোখে তিনি প্রিয় ছিলেন। ন্যায়পরায়ণতা ছিল তাঁর স্বভাবের অংশ। যেকোনো সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে ইনসাফের প্রতি থাকত তাঁর দৃষ্টি। মহান এই নেতা যথাসময়ে সালাত আদায়ে যত্নবান ছিলেন। রাত জেগে তাহাজ্জুদ আদায় ছিল তাঁর চিরকালীন অভ্যাস।
ইতিহাসবিদ আবু শামা সেলজুক ইতিহাস বিশেষ করে নিজামুল মুলকের জীবন- ইতিহাস প্রসঙ্গে লেখেন, ‘তিনি সেলজুক সাম্রাজ্যের উজির হওয়ার পর খিলাফতের (বাগদাদের আব্বাসি খিলাফতের) হারানো গৌরব ও শৌর্য ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হন।
রাষ্ট্রপরিচালায় সুশৃঙ্খল ব্যবস্থাপনা
মালিক শাহ যখন ক্ষমতা গ্রহণ করেন, তখন সেনাবাহিনীর মধ্যে কোনো শৃঙ্খলা ছিল না। সিপাহিরা অবাধে জনগণের সম্পদ লুণ্ঠন করত এবং বলত, ‘নিজামুল মুলক না থাকলে কেউ সুলতান কর্তৃক আমাদের সম্পদ প্রদানে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারত না।' এভাবে সিপাহিদের দ্বারা জনগণ নিপীড়িত হতে থাকলে নিজামুল মুলক সুলতানের সঙ্গে একান্তে সাক্ষাৎ করে বলেন, ‘সুলতান, সেনাবাহিনীর মধ্যে যদি শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা না যায়, তাহলে শক্তিশালী এ বাহিনী অচিরেই দুর্বল হয়ে পড়বে। তাদের প্রভাব-প্রতিপত্তি উবে যাবে। দেশে অরাজকতা ছড়িয়ে পড়বে। এর কুফল প্রতিটি বিভাগে পরিদৃষ্ট হতে থাকবে।' মালিক শাহ তাঁকে বলেন, ‘আপনি যা ভালো মনে করেন করুন, আমার কোনো আপত্তি নেই।' নিজামুল মুলক বলেন, 'কথা ঠিক, তবে আপনার নির্দেশ ছাড়া আমি কিছুই করতে পারি না।' সুলতান বলেন, ‘আমি তো ছোট-বড় সব বিষয় আপনার হাওয়ালা করে দিয়েছি। আপনি আমার পিতার বন্ধু ও সাথি, সে হিসেবে আপনি আমার পিতার সমান। আপনি নিঃসংকোচে কাজ করুন।' এরপর তিনি নিজামকে আরও জায়গির, খিলাত এবং উপাধি দিয়ে ভূষিত করেন।
সুলতান কর্তৃক প্রদত্ত উপাধির মধ্যে একটি ছিল ‘আতাবেক’। আতাবেক মানে ওই আমির, যিনি মর্যাদায় পিতার সমান। নিজামুল মুলকের দূরদর্শী চিন্তাধারা, সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা, যোগ্যতা, বাহাদুরি, জনগণের সঙ্গে নম্র ব্যবহার ও উত্তম আচরণের ফলে জনগণ তাঁর প্রতি নিবেদিত হয়ে যায়।
বলা হয়, একবার জনৈকা বৃদ্ধা তাঁর কাছে কিছু সাহায্য চাইতে আসে। তিনি অনেকক্ষণ ধরে বৃদ্ধার কথা শুনছিলেন। এক প্রহরী বৃদ্ধাকে তাঁর কাছ থেকে সরিয়ে দিতে চাইলে নিজাম তাকে বলেন, ‘আমি তো তোমাকে এদের সেবা-সহায়তার জন্য নিয়োগ দিয়েছি; ধনী আর প্রভাবশালীদের জন্য নয়।' এরপর তিনি ওই প্রহরীকে দায়িত্ব থেকে অপসারণ করেন।
জ্ঞানের প্রতি ভালোবাসা, আলিমদের মর্যাদাদান এবং বিনয়
নিজামুল মুলকের জ্ঞানবিজ্ঞানের প্রতি আগ্রহ ছিল প্রবাদপ্রতিম। তন্মধ্যে হাদিসের জ্ঞানের প্রতি আকর্ষণ ছিল মাত্রাহীন। তিনি বলতেন, ‘আমি হাদিস বর্ণনাকারী হওয়ার উপযুক্ত না হলেও চাই তাঁদের সারিতে যেন আমার নামটা লিপিবদ্ধ থাকে।' 980 তিনি আল্লামা কুশাইরি, মাহার বাজাদ এবং আবু হামিদ আজহারির কাছ থেকে হাদিস শ্রবণ করেন।
নিজামুল মুলক অন্তরের গভীরে এই আশা লালন করতেন, তিনি যে লক্ষ্য সামনে রেখে মাদরাসাগুলো প্রতিষ্ঠা করেছেন, তা যেন পূর্ণতায় পৌঁছায়। উম্মাহ যেন এ থেকে বিপুলভাবে উপকৃত হয়। একবার শাফিয়ি মাজহাবের প্রখ্যাত ফকিহ আবুল হাসান মুহাম্মাদ ইবনু আলি ওয়াসিতি তাঁর কাছে কয়েকটি পক্তি লিখে পাঠান। কবিতার ভাষায় তিনি নিজামুল মুলকের কাছে এ আবেদন রাখেন যে, তিনি যেন হাম্বলি ও আশআরিদের মধ্যকার চলমান ফিতনার মূলোৎপাটনে ভূমিকা রাখেন। পক্তিগুলো তাঁর কানে পৌঁছার পরপরই তিনি শক্তহাতে সেই ফিতনা একেবারে গুঁড়িয়ে দেন। আবুল হাসান মুহাম্মাদ ইবনু আলি ওয়াসিতির সেই পঙ্ক্তিগুলো হচ্ছে :
হে নিজামুল মুলক, বাগদাদের শাসনব্যবস্থা ঢিলে হয়ে পড়েছে শহরে থাকা আপনার সন্তানদের অপমানিত ও লাঞ্ছিত করা হচ্ছে সেখানে তাদের জীবন্ত দাফনের মাধ্যমে হত্যা করা হচ্ছে যারা বেঁচে যাচ্ছে তাদের শরীরে বিদ্ধ রয়েছে বিষাক্ত তির।
হে দীনের প্রহরী, বাগদাদে আজ নিরাপত্তার কোনো জায়গা নেই অবস্থা গুরুতর-সঙ্গিন, সেখানে যুদ্ধের বাজার উত্তপ্ত তির ও তলোয়ার চলতেই থাকবে যাবৎ-না আপনার হাত এই রোগ সারাতে এগিয়ে আসছে।
জালিমরা বাগদাদে হত্যা ও প্রতিশোধের নেশায় মেতেই থাকবে এমন চলতে থাকলে বাগদাদের বিদ্যালয়ের ছাত্ররা বাগদাদকে খোদা হাফিজ জানাতে বাধ্য হবে। তখন আপনার জন্য সম্মান ও শ্রদ্ধার হাতের সঙ্গে হাত মেলানো সুদূর পরাহত হবে।
নিজামুল মুলকের দরবার আলিম ও ফকিহদের উপস্থিতিতে সর্বক্ষণ ভরপুর থাকত। কখনো তিনি সারাদিন তাদের সঙ্গে কাটিয়ে দিতেন। একবার তাঁকে বলা হলো, ‘তাঁদের উপস্থিতি তো আপনাকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ থেকে উদাসীন করে রাখছে।' জবাবে তিনি বলেন, ‘তাঁরা তো উভয় জগতের সৌন্দর্য, আমি তাঁদেরকে আমার পাশে বসিয়ে রাখলেও তাঁদের হক আদায় হবে না।' ফকিহ আবুল কাসিম কুশাইরি এবং আবুল মাআলি জুয়াইনি যখনই তাঁর দরবারে প্রবেশ করতেন, তিনি তাঁদের সম্মানে দাঁড়িয়ে যেতেন। তাঁদের পাশে বসিয়ে দিতেন।
আর আবু আলি ফারিন্দি এসে উপস্থিত হলে তো তাঁর সম্মানে নিজ আসনটাই ছেড়ে দিতেন। নিজ আসনে তাঁকে বসিয়ে ছাত্রের মতো সামনে বসে থাকতেন। একবার তাঁকে এরূপ আচরণের কারণ জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, 'আবুল কাসিম কুশাইরি আর আবুল মাআলি জুয়াইনি আমার দরবারে এলে আমাকে এমন সম্মান দেখান এবং এমনসব প্রশংসা করেন, যা আমার মধ্যে মোটেও নেই। তাঁদের কথা শুনে আমি আত্মম্ভরিতায় ফুলে উঠি। পক্ষান্তরে আবু আলি ফারিন্দি এলে আমার ত্রুটি-বিচ্যুতি নিয়ে আমাকে সাবধান করেন, ফলে আমি সেগুলো থেকে বেঁচে থাকতে পারি।
ইবনু আসির লেখেন,
‘নিজামুল মুলক ছিলেন একজন প্রাজ্ঞ আলিমে দীন, দীনদার, দানশীল, ন্যায়পরায়ণ, ধৈর্যধারণকারী, ক্ষমাপ্রিয় এবং নীরবতা পছন্দকারী ব্যক্তি। তাঁর দরবারে সবসময় কারি, ইমাম, উলামা এবং জ্ঞানী ব্যক্তিদের ভিড় লেগে থাকত। তিনি ছিলেন কুরআনের হাফিজ। ১১ বছর বয়সে কুরআন মুখস্থ করে শাফিয়ি ফিকহ অর্জনে মনোযোগ দেন। সর্বদা অজু অবস্থায় থাকতেন। আর যখনই অজু করতেন দু-রাকআত তাহিয়্যাতুল অজুর সালাত আদায় করে নিতেন।" আজানের শব্দ কানে পৌঁছার সঙ্গে সঙ্গে যত গুরুত্বপূর্ণ কাজই থাকুক, তা সেখানে রেখে মসজিদে চলে যেতেন। সালাত না পড়া পর্যন্ত কোনো কাজে হাত লাগাতেন না। কখনো সালাতের সময় মুয়াজ্জিনের আজান দিতে দেরি হলে তিনি নিজে এগিয়ে গিয়ে আজানের ব্যবস্থা করতেন। সময়ানুবর্তিতা আর যথাসময়ে সালাত আদায়ের ব্যাপারে তিনি ওই স্তরে উপনীত ছিলেন, যা কেবল দুনিয়াত্যাগী ইবাদতগুজারদের ভাগ্যে জুটে থাকে।
এককথায় পূর্ণাঙ্গ মানুষ বলতে যা বোঝায়, তিনি ছিলেন তা-ই। তিনি বলেন, একবার আমি স্বপ্নে ইবলিসকে দেখতে পেয়ে তাকে জিজ্ঞেস করি, 'তোর ধ্বংস হোক! আল্লাহ তোকে সৃষ্টি করে আদমকে সিজদা করার নির্দেশ সরাসরি দিয়েছিলেন; কিন্তু তুই আল্লাহর কথা শুনিসনি। দেখ! আমাকে তিনি সরাসরি সিজদার নির্দেশ না দিলেও আমি দৈনিক তাঁকে কতবার সিজদা দিয়ে থাকি।” এরপর তিনি এই পক্তি আওড়ান :
যে বন্ধুর মিলনের উপযুক্ত নয়, তার সব পুণ্যকাজও গুনাহের নামান্তর।
তাঁর চাওয়া ছিল, তাঁর থাকবে একটা মসজিদ, যেখানে তিনি ইবাদত করবেন এবং দৈনিক কোথাও থেকে একটা রুটি পাবেন। এ ব্যাপারে তাঁর নিজের কথা হচ্ছে, "আমি সর্বদা এই আকাঙ্ক্ষা হৃদয়ে পোষণ করি, একটি ছোট্ট গ্রামে একটি মসজিদ থাকবে; আর আমি দুনিয়ার যাবতীয় সম্পর্কচ্ছেদ করে সেখানে ইবাদতে লিপ্ত থাকব।'
বিনয় আর শিষ্টতার অবস্থা ছিল এই, একবার দস্তরখানের একপ্রান্তে ছিলেন তাঁর ভাই আবুল কাসিম; আর অপরপ্রান্তে ছিলেন খোরাসানের গভর্নর। গভর্নরের পাশে ছিল হাতকাটা এক ভিক্ষুক। নিজামুল মুলক খেতে বসে লক্ষ করেন, গভর্নর ভিক্ষুকের সঙ্গে আহারক্রিয়া এড়াবার চেষ্টা করছেন। নিজামুল মুলক তখন ভিক্ষুককে বলেন, ‘এসো, তুমি আমার সঙ্গে আহার করবে।' এরপর তিনি তাকে পাশে বসিয়ে একত্রে আহার করেন। অনেক সময় তাঁর জন্য ব্যবস্থা করা খাবার ভিক্ষুকদের খাইয়ে দিতেন; অথবা তাদের সঙ্গে বসে খেয়ে নিতেন।
তাঁর রচিত কাব্য,
৮০ বছরের পর শক্তি ও উদ্দীপনা কিছুই অবশিষ্ট নেই
আমি যেন মুসা, আমার হাতে রয়েছে একটা লাঠি, তবে নবুওয়াতহীন।
এ ছাড়া নিম্নের পঙ্ক্তিগুলোও তাঁর সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত করা হয়ে থাকে
বার্ধক্য আমার কোমরটা ধনুক বানিয়ে ফেলেছে রাতগুলো যেন আমাকে পা দিয়ে মাড়িয়ে চলছে। আমার অবস্থা হচ্ছে, আমার লাঠি আমার আগে আগে চলে এগুলো যেন ধনুকের কঠিন ছিলা।
নিজে কবিতা আবৃত্তির পাশাপাশি অন্য কবিদেরও আবৃত্তি শুনতেন। তাঁদের কথায় প্রভাবান্বিত হতেন। একবার তিনি রোগাক্রান্ত হলে আবু আলি কুমসানি তাঁকে দেখতে এসে তাঁকে শুনিয়ে শুনিয়ে এই পক্তি আবৃত্তি করছিলেন :
যখন আমরা পীড়িত হই তখন পুণ্যকাজের নিয়ত করি
কিন্তু সুস্থ হলে সত্য থেকে বিমুখ হয়ে পাপে লিপ্ত হয়ে পড়ি। ;
ভীতির পরিবেশে আমরা প্রকৃত ইলাহের শরণ চাই
নিরাপদ পরিবেশে আমরা তাঁকে অসন্তুষ্ট করে চলি,
তখন আমাদের আমল পরিচ্ছন্ন থাকে না।
তখন নিজামুল মুলক কেঁদে কেঁদে বলছিলেন, ‘কবির বর্ণিত সেই হতভাগা আমিই। কবি এখানে আমাকেই চিত্রায়িত করেছেন।
ইনতিকাল
৪৮৫ হিজরির ১০ রমজান, বৃহস্পতিবার। ইফতারের সময় হলে নিজামুল মুলক মাগরিবের সালাত শেষে দস্তরখানে বসে পড়েন। দস্তরখানে ছিল হাফিজ, কারি, আলিম ও ফকিহদের এক বিশাল জামাআত। আহার শেষে নিজামুল মুলক ইসলামের সোনালি ইতিহাসের প্রসঙ্গ টেনে আনেন। তিনি বলে যাচ্ছিলেন খলিফা উমর ইবনুল খাত্তাব রা.-এর শাসনামলের স্বর্ণালি দিনগুলোর কথা। পরিচয় দিচ্ছিলেন নাহাওয়ান্দযুদ্ধের সেই বরকতময় প্রান্তরের, যেখানে শিবির স্থাপন করেছিলেন সাহাবিগণের মোবারক জামাআত। বলছিলেন কোথায় কোথায় সংঘর্ষ হচ্ছিল মুসলিমবাহিনীর সঙ্গে অগ্নিপূজারি পারস্যবাসীর। সেখানে কোন সৌভাগ্যবানরা পান করেছিলেন শহিদি সুধা। শহিদদের আলোচনা শেষে আবেগমাখা কণ্ঠে বলছিলেন, ‘কত-না সৌভাগ্যবান ছিলেন তাঁরা, যাঁরা এই শহিদানের সঙ্গ দিয়েছিলেন।’
মজলিস শেষ হলে তিনি পা বাড়ান বাড়ির দিকে। পেছনে পেছনে চলছিল দুরাচার হারিস দায়লামি। ভঙ্গি ছিল অপরাধীর কিংবা সাহায্যপ্রার্থীর; কিন্তু তার ভেতরে ছিল ঘৃণ্য জিঘাংসা। অকস্মাৎ বর্শা মেরে বসে তাঁর বুকে। মোক্ষম আঘাতে সঙ্গে সঙ্গে শাহাদাতের পেয়ালায় উপুড় হয়ে পড়েন উম্মাহর এই স্বপ্নপুরুষ। তাঁর প্রাণহীন দেহ নিয়ে যাওয়া হয় বাড়িতে।
সন্ত্রাসী গোষ্ঠী বাতিনিদের দ্বারা প্রথম শহীদ নিজামুল মুলক তুসি রাহ.
বলা হয়, নিজামুল মুলক তুসি রাহ.-ই ছিলেন সন্ত্রাসী গোষ্ঠী বাতিনিদের গুপ্তহত্যার প্রথম শিকার। নিজামুল মুলকের মৃত্যুখবর দাবানলের মতো মুহূর্তের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র। সংবাদ শোনার সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার দিয়ে ওঠে পুরো মুসলিম সৈন্যবাহিনী। সুলতান মালিক শাহ ব্যথা ও চিন্তায় এমনভাবে ডুকরে কেঁদে উঠেছিলেন, মনে হচ্ছিল এই বুঝি তাঁর প্রাণবায়ু বেরিয়ে পড়বে। তিনি ঘণ্টাখানেক শহিদ তুসির প্রাণহীন দেহ আঁকড়ে পড়ে থাকেন।
নিজামুল মুলক ইসলামের অগ্রগতির লক্ষ্যে ওয়াকফ করেছিলেন তাঁর সারাটা জীবন; আর এই দীনের খাতিরেই তিনি পান করেন শাহাদাতের শিরিন শরাব।
অভিশপ্ত হত্যাকারী দ্রুত পালাতে গিয়ে তাঁবুর রশির সঙ্গে জড়িয়ে হোঁচট খেয়ে পড়ে যায়। নিজামুল মুলকের দাসরা তাকে সেখানেই টুকরো টুকরো করে ফেলে। তাঁর খাদিমগণ বর্ণনা করেন, নিজামুল মুলকের জীবনের শেষকথা ছিল, ‘আমার হত্যাকারীকে মেরে ফেলো না। আমি তাকে ক্ষমা করে দিয়েছি।' এ কথা বলার পরপরই তিনি কালিমায়ে শাহাদাত উচ্চারণ করে চিরদিনের মতো নীরব হয়ে যান।
পুরো বাগদাদ শোকে স্তব্ধ নগরীতে পরিণত হয়ে ওঠে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে তিন দিনের শোকদিবস ঘোষণা করা হয়। কবিরা তাঁর শোকগাথায় হৃদয়ছোঁয়া কাব্য আবৃত্তি করেন। তাঁদের মধ্যে কবি মুকাতিল ইবনু আতিয়্যাহর মর্সিয়া হচ্ছে :
উজির নিজামুল মুলক ছিলেন এক দুষ্প্রাপ্য মোতি,
রহমান তাঁকে বিশেষ ছাঁচে ফেলে তৈরি করেছিলেন।
বিরল সেই মহানায়ককে সময় মূল্যায়ন করেনি।
তাঁর এক শত্রু তাঁকে এ ধূলিমলিন পরিবেশ থেকে আবার ঝিনুকের ভেতর ঢুকিয়ে দিয়েছে।
আল্লামা ইবনু আকিল রাহ. নিজামুল মুলক সম্পর্কে বলেন,
‘নিজামুল মুলকের বদান্যতা, অন্তরের উদারতা, ন্যায়পরায়ণতা এবং ইসলামি রেনেসাঁর জন্য জীবন বিলিয়ে দেওয়ার প্রয়াস মানুষকে হতবাক করে দিয়েছিল। তাঁর সময়কাল ছিল প্রজ্ঞাবানদের শাসনকাল। তাঁর শাহাদাতের সঙ্গে সঙ্গে সেই যুগের পরিসমাপ্তি ঘটে গেছে। রমজানের পর তাঁর হজের সফরে যাওয়ার কথা ছিল; কিন্তু তিনি আখিরাতের পথিক হয়ে যান। আল্লাহ তাঁর ওপর রহমতের ধারা বর্ষণ করুন। তিনি দুনিয়া ও আখিরাতের একজন বাদশাহের মতো ইহধাম ত্যাগ করেছেন।
নিজামুল মুলক অর্থ কি | নিজাম উল মুলক কার উপাধি | ড. আলি মুহাম্মাদ সাল্লাবি | তাজুল মুলক | নিজামুল মূলক বিখ্যাত কেন | নিজামিয়া মাদ্রাসা | সিয়াসাতনামা pdf |সিয়াসাতনামা গ্রন্থের লেখক কে | আকচা হাতুন সেলজুক | নিযামুল মুলকের হত্যাকান্ড | YouTube | Facebook | Google
Post a Comment