মালিক শাহ সেলজুকির খিলাফত
আলপ আরসালানের ইনতিকালের পর তাঁর পুত্র মালিক শাহ রাজমসনদে আসীন হন; কিন্তু কিরমানের সেলজুক-অধিপতি তাঁর চাচা কাওরুদ বেগ ইবনু জাফরি বেগ তাঁর সিংহাসনে আরোহণের ব্যাপারটি না মেনে নিজেকে সিংহাসনের অধিকারী হিসেবে ঘোষণা দেন। ফলে হামদানের নিকটবর্তী প্রান্তরে চাচা-ভাতিজার মধ্যে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ সংঘটিত হয়। যুদ্ধে কাওরুদ (কার্ভুদ) বেগ মারা যান। কিরমান দখল করার পর মালিক শাহ ৪৬৫ হিজরি; ১০৭৩ খ্রিষ্টাব্দে তদীয় ভাই সুলতানশাহ ইবনু আলপ আরসালানাকে সেখানকার শাসক বানিয়ে পাঠান।
সুলতান মালিক শাহর যুগে সেলজুক সালতানাত উন্নতির শীর্ষচূড়ায় পৌঁছে যায়। তখন পূর্বে আফগানিস্তান, পশ্চিমে এশিয়া মাইনর, দক্ষিণে বিশাল শাম সেলজুক সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। সেলজুক সাম্রাজ্যের এ বিস্তৃতি ৪৬৮ হিজরি; ১০৭৫ খ্রিষ্টাব্দে সেনাপতি আসজের হাতে দামেশক বিজয়ের মধ্য দিয়ে সম্পাদিত হয়েছিল। মালিক শাহ বিজয়ের ধারা গতিশীল রাখার জন্য ৪৭০ হিজরি; ১০৭৭ খ্রিষ্টাব্দে তদীয় ভ্রাতা তাজুদ দৌলাহ তুতমুশের হাতে শামের নেতৃত্বভার ছেড়ে দেন। মূলত তাজুদ দৌলাহই ছিলেন শামে সেলজুক সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা। শামের মতো এশিয়া মাইনরের নেতৃত্ব তুলে দেন আরেক আত্মীয় সুলায়মান ইবনু কুতলামাশ ইবনু ইসরাইলের হাতে। সুলতান মালিক শাহর ইচ্ছে ছিল তিনি জিহাদের এ ধারা এগিয়ে নেবেন। ইতিপূর্বে এশিয়া মাইনর ছিল রোমান বাইজেন্টাইনদের কর্তৃত্বাধীন। সুলায়মান ইবনু কুতলামাশ তাদের হাত থেকে ছিনিয়ে এনে এখানে সেলজুক সাম্রাজ্যের ভিত গড়ে তোলেন।
যেভাবে সেলজুক সম্রাজ্য শতধাবিভক্ত হয়
কালের বিবর্তনে শতধাবিচ্ছিন্ন সেলজুক সাম্রাজ্য হারিয়ে গেলেও এশিয়া মাইনরে তাদের এই সাম্রাজ্য ২২৪ হিজরি পর্যন্ত রাজত্ব পরিচালনা করেছিল। দীর্ঘ এ মেয়াদে আবুল ফাওয়ারিস সুলায়মান ইবনু কুতলামাশের ১৪ জন উত্তরসূরি রাজ্য পরিচালনা করেছিলেন। সুলায়মানকে সালাজাকায়ে রোমের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে গণ্য করা হয়। 100 সুলায়মান ৪৭৭ হিজরি; ১০৮৪ খ্রিষ্টাব্দে এন্টিয়ক (এন্তাকিয়া) জয় করেন। এরপর তাঁর পুত্র দাউদ ৪৮০ হিজরি; ১০৮৭ খ্রিষ্টাব্দে কোনিয়া জয় করে সেখানে রাজধানী প্রতিষ্ঠা করেন। কোনিয়া ছিল তৎকালীন এশিয়া মাইনরের দৃষ্টিনন্দন ও সমৃদ্ধতম এলাকা। সেলজুকরা শহরটি বাইজেন্টাইনদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়েছিল। এরপর ৭০০ হিজরি; ১৩০০ খ্রিষ্টাব্দে এ সাম্রাজ্য মোঙ্গল ঝড়ে লন্ডভন্ড হয়ে যায়। এরপর তা উসমানি সাম্রাজ্যের অধীনে চলে আসে।
রোমের সেলজুকদের স্বপ্ন ছিল তারা এশিয়া মাইনরকে একটি তুর্কি-সুন্নি সাম্রাজ্যরূপে গড়ে তুলবে। এ অঞ্চলে তাদের হাত ধরেই ইসলামি সভ্যতা প্রচার পেয়েছিল। তারাই সেই অপরিচয়ের দেয়াল গুঁড়িয়ে দিয়েছিল, যা ইউরোপে ইসলামের প্রসারের ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়ানো ছিল।
মালিক শাহর শাসনামলে যদিও সাম্রাজ্য যথেষ্ট শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল; কিন্তু তারপরও সেনাপতি আত্মজ শাম এবং মিসরকে পূর্ণাঙ্গভাবে সাম্রাজ্যের সঙ্গে একীভূত করতে ব্যর্থ হন। অথচ ইতিপূর্বে তিনি মিসরের ফাতেমি সালতানাতকে ধ্বংসের চ্যালেঞ্জ দিয়ে রেখেছিলেন। আজ মিসরের উপর হামলা চালালে মিসরিরা সেনাপতি বদর আল-জামালির নেতৃত্বে ময়দানে নেমে আসে। এরপর রজব ৪৬৯; ১০৭৬ খ্রিষ্টাব্দে বদর আল-জামালির নেতৃত্বাধীন মামুলি একটি বাহিনী আসজের বাহিনীকে চরমভাবে বিপর্যস্ত করে দেয়। আৎসতিজের এ পরাজয়ের পরিপ্রেক্ষিতে সেলজুক সাম্রাজ্য অধিকতর বিচ্ছিন্নতার শিকারে পরিণত হয়। তখন রাজনৈতিক মতবিরোধ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ চলতে থাকে। অবশেষে ৪৭১ হিজরি; ১০৭৮ খ্রিষ্টাব্দে আত্মজ মারা যান।
এভাবে বিচ্ছিন্নতা মাথাচাড়া দিয়ে উঠার কারণেই মালিক শাহ আব্বাসি খিলাফতকে সেলজুকি সাম্রাজ্যে পরিবর্তন করতে সফল হননি। মালিক শাহ ৪৮০ হিজরি; ১০৮৭ খ্রিষ্টাব্দে খলিফা মুকতাদি বিল্লাহর সঙ্গে তাঁর কন্যাকে বিয়ে দিয়েছিলেন। তাঁর গর্ভে সুলতানের একপুত্র জন্মগ্রহণ করে। আরেক মেয়েকে খলিফা মুসতাজহির বিল্লাহ আব্বাসির সঙ্গে বিয়ে দিয়েছিলেন; কিন্তু অনেক চেষ্টার পরও ক্ষমতা তাঁর দৌহিত্রদের হাতে তুলে দিতে পারেননি।
সুলতান মালিক শাহর ইনতিকাল
সুলতান মালিক শাহর ইনতিকালের সঙ্গে সঙ্গে সেলজুক সাম্রাজ্যের সেই শক্তি, প্রতাপ, গুরুত্ব ও মর্যাদা হ্রাস পেতে থাকে, যা ৪৪৭–৪৮৫ হিজরি; ১০৫৫–১০৯২ খ্রিষ্টাব্দ থেকে তুগরুল বেগ, আলপ আরসালান এবং মালিক শাহর যুগ থেকে চলে আসছিল। তাঁর ইনতিকালের সঙ্গে সঙ্গে গৃহযুদ্ধের মাধ্যমে সাম্রাজ্যের পতনযুগ শুরু হয়। মালিক শাহর যুগে বিশ্ব রাজনীতির মঞ্চে আরেক ঐতিহাসিক ব্যক্তির প্রকাশ ঘটেছিল, যিনি আল্লাহপ্রদত্ত যোগ্যতাবলে অনেক রাজা-বাদশাহদেরও ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন। তিনি ছিলেন তাঁর প্রধানমন্ত্রী নিজামুল মুলক তুসি রাহ., যাঁর প্রজ্ঞা এবং সুশাসনের বদৌলতে সেলজুক সালতানাত দৃঢ় ভিত্তি পেয়েছিল।
সেলজুক সুলতানদের তালিকা | সেলজুক সাম্রাজ্যের শেষ সুলতান কে | সুলতান আহমেদ সেনজার | সেলজুক সুলতান মালিক শাহের কৃতিত্ব
সোর্স; উসমানি খিলাফতের ইতিহাস
আরও পড়ুন:-
Post a Comment