বিয়ের কথা: পাত্র-পাত্রীর দৃষ্টিভঙ্গি || Biyer kotha

ড. সাজেদা হোমায়রা

.
বিয়ের কথা মানেই অনেক অনেক মেয়ে দেখার ধুম! আর মেয়ে দেখতে গিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখা হয় মেয়ের গায়ের রঙ, উচ্চতা, চুল, নাক, দাঁত ইত্যাদি।
.
মেয়ে পক্ষও মেয়েকে হেভি মেকাপে নিয়ে এনে বসিয়ে দেয় ছেলে পক্ষের সামনে। ছেলেপক্ষও খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে। কখনো দোষ ধরে। মন চাইলে পছন্দ করে, না চাইলে করে না!
.
মেয়ের বাবা নানা আয়োজন করে মেয়েকে দেখানোর জন্য ছেলে পক্ষকে দাওয়াত করে। আর ছেলেপক্ষ ফোন করে বলে দেয়— 'মেয়ে আমার পছন্দ হয়নি!' তখন সেই মেয়েটার মনের ভেতর কি চলে সেই খবর কি কেউ রাখে?
.
এতো আয়োজনের পরও যখন বিয়েটা হয় না, সেটা একটা মেয়ের জন্য কতটা চরম মানসিক আঘাতের কারণ হয়ে সেটা কি ছেলেপক্ষ কখনো ভেবে দেখে? মেয়েটা হয়তো লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদে অথবা চরম হীনমন্যতায় ভোগে!
.
আবার অনেকসময় মেয়েপক্ষও বিভিন্নভাবে ছেলেকে কষ্ট দেয়। ছেলের ইনকাম কম, হ্যান্ডসাম কম, হাইট কম অথবা নিজের আলাদা বাসা নাই ইত্যাদি কারণে ছেলেকে অপমানিত করে। তখন ছেলেটাও হীনমন্যতায় ভোগে!
.

কিন্তু বিষয়টা কি আসলেই এমন হওয়ার কথা ছিল?

biyer kotha


বিয়ের প্রস্তাব এবং কথাবার্তার সময় এটা খেয়াল রাখা খুবই জরুরি, কোনো পক্ষেরই যেন এতে সম্মানহানি না হয় বা কোনো পক্ষই যেন কষ্ট না পায়।
.
মেয়ে দেখতে হবে তখনই, যখন সবকিছু ঠিক হয়ে গেছে, এখন শুধু মেয়ে পছন্দ হলেই বিয়ে হবে। এর আগে ছবি দেখা যেতে পারে। প্রয়োজনে ছেলের ফ্যামিলির মহিলারা মেয়েকে দেখতে পারে। সব খোঁজ-খবর নেয়ার পর বিয়ের বিষয় নিশ্চিত হয়ে গেলে তখন ছেলে ও মেয়ে উভয় উভয়কে দেখতে পারে। সেসময় এ দেখাদেখির বিশেষ উদ্দেশ্য হলো, বিয়ের ব্যাপারে পারস্পরিক আগ্রহ, মায়া ও ভালোবাসা সৃষ্টি হওয়া।
.
ইসলাম পছন্দনীয় মেয়েকে বা ছেলেকে বিয়ে করতে উৎসাহিত করে অর্থাৎ যার দিকে মন টানে।
কুরআনে বলা হয়েছে:
"তোমরা বিয়ে করো সেই মেয়েদের যাদের তোমাদের ভাল লাগে।[১]"
.
হাদীস থেকে জানা যায়— মুগীরা ইবনে শু’বা রা. এক মেয়েকে বিয়ে করার ইচ্ছা পোষণ করে ছিলেন। তখন রাসূলুল্লাহ সা. তাকে বললেন, 'যাও, পাত্রী দেখে এসো। কারণ, এ দেখা তোমাদের মাঝে আগ্রহ সৃষ্টির ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা পালন করবে।' মুগীরা রা. বলেন, 'একথা শুনে আমি পাত্রী দেখে এসেছিলাম।[২]'
.
ইসলামের নির্দেশনা হচ্ছে, মেয়েও ছেলেকে দেখে নিবে। উমর রা. বলেছেন, বিয়ের আগে পুরুষের যেমন নারীর কিছু বিষয় দেখে নেয়ার রয়েছে, তেমনি নারীরও অধিকার রয়েছে তার সঙ্গীকে দেখে বেছে নেয়ার।
.
ইসলামে বিয়ের ক্ষেত্রে মূলত দ্বীনতারিতাই মুখ্য বিষয় তাই ছেলে পছন্দ করার ক্ষেত্রে অবশ্যই প্রথমে দ্বীনদারিতাই গুরুত্ব পাবে। সেই সাথে চারিত্রিক সৌন্দর্যকেও প্রাধান্য দিতে হবে। আর অবশ্যই খোঁজ নিতে হবে ছেলের উপার্জন হালাল কি না। সংসারে হারাম উপার্জন থাকলে সব আমলই বরবাদ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। অনেকসময় দেখা যায়, ছেলে যতই দ্বীনদার হোক, তার ইনকাম কিছুটা কম শুনলে মেয়েপক্ষ একটু ইতস্তত বোধ করে। পিছু হটে যায়। কিন্তু এটা মনে রাখতে হবে, হালাল আয় কম হলেও তাতেই কল্যাণ। আল্লাহ তাতেই বারাকাহ দেন।
.
ইসলামে বিয়ের ব্যাপারে মেয়ে পক্ষকে বলা হচ্ছে, তারা যেন শুধু ছেলের দারিদ্রতার জন্য বিয়ের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান না করে আর ছেলেদের বলা হচ্ছে বেশি সচ্ছলতার অপেক্ষায় বিয়ে যেন দেরিতে না করে। সামান্য হলেও আল্লাহর উপর ভরসা করে বিয়ে করা উচিত।
.
রাসূল সা. বলেছেন, নারীদের (সাধারণত) চারটি বিষয়ে দেখে বিয়ে করা হয়। এগুলো হলো—
১. তার ধন-সম্পদ
২. বংশ মর্যাদা
৩. রূপ-সৌন্দর্য
৪. দ্বীনদারিতা
সুতরাং তুমি দ্বীনদারীকেই প্রাধান্য দিবে নতুবা তুমি ক্ষতিগ্রস্ত হবে।[৩]
.
ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহ.) বলেছেন:
'কোন পুরুষ যদি কোন নারীকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়, তাহলে সর্বপ্রথম তাঁর সৌন্দর্য সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করবে। যদি এ ব্যাপারে তার প্রশংসা করা হয়, তাহলে তার দ্বীন সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করবে। দ্বীনের ক্ষেত্রে প্রশংসিত হলে তাকে বিয়ে করবে অন্যথায় দ্বীনের কারণে প্রত্যাখ্যান করবে।
.
প্রথমেই মেয়ের দ্বীনদারি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করতে না করা হয়েছে এজন্য যে, যেন প্রত্যাখানটা সৌন্দর্যের কারণে না হয় বরং দ্বীনদারিতার উপর ভিত্তি করেই হয়। কারণ দ্বীনদারিতা সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার পর যদি মেয়ের সৌন্দর্য সম্পর্কে প্রশংসনীয় কিছু না পাওয়া যায়, তাহলে হয়তো এই প্রস্তাব প্রত্যাখান করা হতে পারে। আর এই প্রত্যাখানটা তখন হবে সৌন্দর্যের কারণে, দ্বীনদারিতার কারণে নয়। আর এটি একজন মেয়ের মর্যাদার পরিপন্থী।
.
একটা কথা মনে রাখা খুবই জরুরী। সেটা হলো, বাহ্যিক সৌন্দর্যই কিন্তু আসল সৌন্দর্য নয়। মেয়ে বা ছেলে দেখতে যেমনই হোক, বাহ্যিক সৌন্দর্যহীনতার কারণে সে বিয়ের অযোগ্য হয়ে যায় না। আল্লাহর কাছে বাহ্যিক সৌন্দর্যের চেয়ে দ্বীনদারিতার মূল্য অনেক বেশি।
.
আর বিয়ের ক্ষেত্রে একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হচ্ছে, দুই পক্ষকেই ছাড় দিতে হয়। কারণ পৃথিবীতে কেউই কখনো পারফেক্ট হয় না। আল্লাহ একেকজনকে একেকদিকে গুন ও যোগ্যতা দান করেছে, কেউ একেবারে অযোগ্য নয়, আবার কেউ একেবারে নিখুঁতও নয়। তাই বিয়েতে করনীয় হচ্ছে উভয় পক্ষ উভয় পক্ষকে বিভিন্ন বিষয়ে ছাড় দেওয়া ও উদারতা প্রদর্শন করা।
.
মৌলিকভাবে দ্বীনদারীতা মূল্যায়ন করে বাকিগুলোতে যথাসাধ্য ছাড় দেওয়া। সংকীর্ণতা ও খুতঁখুঁতে দৃষ্টিভঙ্গিও এভয়েড করা উচিত। শরীয়তের বিধান মানার মানসিকতা গড়ে উঠুক সবার মাঝে।
.
তথ্যসূত্র:
[১] সূরা নিসা:৩
[২] সুনানে বাইহাকী: ১৩৪৮৮
[৩] মুসলিম: ১৪৬৬
-------------------------

Post a Comment

Previous Post Next Post